যে বিল বর্ষায় মাছে সেরা, বাকি সময় ধানে

এক বিলের ধান চাষের পাশাপাশি মৎস্য আরোহণ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার জেলেরা। আজ সকালে বিলের ঘাটে পাঁচটি আড়তে চলছে মাছের কারবার। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

বিলের এক মাথা দেশে, আরেক মাথা ভারতে। বর্ষায় আরও ফুলে–ফেঁপে ওঠে, তখন বিলটির কোনো সীমানা থাকে না। আর পানিতে চলাচলকারী মাছেরও কোনো নির্দিষ্ট দেশ থাকে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই বিলটিই তাঁদের বানিয়েছে ‘ধানের ধনী আর মাছের রাজা’।

বিলের প্রায় ১২ হাজার বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়। আর সেখানেই বর্ষার আগে–পরে মিলিয়ে পাঁচ মাস মেলে নানা পদের মাছ। বর্তমানে প্রতিদিন শুধু সকালে সেখান থেকে ধরা হয় প্রায় ৫০ মণ মাছ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নে বিলটির অবস্থান। নাম বিলকুজাইন। বিলসংলগ্ন গঞ্জের ঘাটে প্রতিদিন সকালে বসে মাছের আড়ত।

স্থানীয় লোকজন বলেন, বিলকুজাইন বিলের মোট ছয়টি অংশ আছে। এগুলো হচ্ছে চনসদা, তেলকুচ, গুমরৈল, দোবলাইন্দ, রুহিমারি, শুকডুবা। এসব অংশে শুকনা মৌসুমে বোরো ধানের চাষ হয়। বাকি সময় ধানি জমিতেই পাওয়া যায় মাছ।

বিলটিতে ২০ বিঘা জমি আছে লুৎফর রহমান নামের স্থানীয় এক বাসিন্দার। তিনি বলেন, নিচু জমিতে শুধু একবার ধান পান। কিছু উঁচু জমিও আছে, এগুলোতে শর্ষের চাষ হয়। আর মাছ ছাড়া কিছুই হয় না। তাঁর ভাষায়, ‘বলতে পারেন, হামরা (আমরা) ধানে ধনী, আর মাছে রাজা।’

সম্প্রতি এক সকালে গঞ্জের ঘাট গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে শতাধিক নৌকা ভিড়েছে সেখানে। এর আগে থেকেই চারদিকে শুরু হয় মানুষের হাঁকডাক। ঘাটেই জেলেরা নৌকায় বসে মাছ বাছাই করতে বসে যান। চিংড়ি, পুঁটি, বাইম, ট্যাংরা, চ্যালা, শিংসহ স্থানীয় আরও বিভিন্ন নামের সব ছোট মাছ ধরা পড়ে তাঁদের জালে। একেক মাছের দামও একেক রকম। এ জন্য সেগুলো আলাদা করে বিক্রি করা হয়।

বিলের পানির ওপর নৌকা ও জাল রাখেন জেলেরা
ছবি: প্রথম আলো

জেলে আসমাউল, বেলাল ও হাবিব নৌকার পাশে বসে মাছ বাছাই করছিলেন। ছবি তুলতে গেলে তাঁদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন, ‘হামরা লেংটি মাইরি মাছ বাচ্ছি, সব ভিডিও কইরে লিলোরে।’ তাঁদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে জানা গেল, শ্রাবণ মাস থেকে ফাগুন মাস পর্যন্ত বিলটিতে মাছ পাওয়া যায়। আর মাত্র কিছুদিন, এরপর পানি শুকিয়ে গেলে অনেক জায়গায় ধান রোপণ করা হবে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, শতাধিক নৌকা নিয়ে ভোররাতে বিলে নেমে পড়েন তাঁরা। জাল টেনে মাছ ধরে সকালে একবার ও দুপুরে আরেকবার মাছ নিয়ে ঘাটে ফেরেন। আড়তে বিক্রি করে দুপুরের পরে আবার বাড়ি ফিরে যান। এ সময় তাঁদের জাল-নৌকা ঘাটেই রেখে যান।

বর্ষার সময় গঞ্জের ঘাটটি ডুবে যায়। মাটির দেয়াল দিয়ে গড়া ঘাটের সব ঘরও নষ্ট হয়ে যায়। পানি একটু কমলে কাদা দিয়ে আবার দেয়াল তোলার কাজ শুরু হয়। কয়েকজন ওপরে টিনের চালা ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘর বানিয়ে সেখানেই আড়তদারি করছেন। আর কয়েকজন কাদা দিয়ে নতুন ঘরের দেয়াল তুলছেন। এসব আড়ত ঘিরে ক্রেতা বিক্রেতার ব্যাপক ভিড় লেগে থাকে।

আড়তদার পাল্লায় মাছ তুলে দাম হাঁকছেন। একেকটি আড়তকে ঘিরে আছেন অসংখ্য মানুষ। এই বন্দরের মাছ প্যাকেটজাত করার জন্য বিলের কিনারে বরফ মিলও বসানো হয়েছে। কেউ কেউ বাইরে থেকেও বরফ নিয়ে আসছেন।

নিতপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম নওগাঁর পোরশার বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাছ কিনেছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তি। তাঁরা খয়রা মাছ কিনেছেন ৩০ কেজি। এরপর তাঁদের যেন দম ফেলার সময় নেই। কত তাড়াতাড়ি বরফ দিয়ে মাছ ঢেকে বাক্সে ভরা যায়, সেদিকেই মনোযোগ।

লোকজনের ভিড় কিছুটা কমলে আড়তদার বাবুল আক্তার বলেন, গড়ে প্রতিদিন এই বিল থেকে ৫০ মণ করে বিভিন্ন ধরনের মাছ ওঠে। শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত এই পাঁচ মাস রমরমা ব্যবসা হয়। এরপর যে মাছ পাওয়া যায়, সেগুলো স্থানীয় বাসিন্দারা ধরে নিজেরা খান, বিক্রি করার মতো হয় না।

ঘাট থেকে রাস্তায় উঠে দেখা যায় ভোলাদিঘি গ্রামের আটজন মাছ বেচাকেনা শেষে একটি ভটভটিতে উঠে বসেছেন। তাঁরা বলেন, তাঁদের আটজনের একটি জাল। বুনতে খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। প্রতিদিন ভোর চারটায় আসেন মাছ ধরতে। এরপর বিক্রি শেষে দুপুরের দিকে বাড়ি ফেরেন। তাঁদের নিজেদের নৌকা আছে, জাল আড়তদারের কাছে রেখে চলে যান।