ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা, দিনে রাতে দূষণ

সিসা কারখানার পাশে ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা। দিনে অ্যাসিড আর রাতে ধোঁয়ার গন্ধে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।

শ্রমিকেরা ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে প্লেট (ব্যাটারির ভেতর থাকা পাত) বের করছেন। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় পাটুরিয়া ঘাট এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় একটি কারখানায় ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হচ্ছে। উপজেলার পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় পদ্মা নদীর পাড়ে কারখানাটির অবস্থান। এই কারখানার ব্যাটারি পোড়ানোর কালো ধোঁয়া ও অ্যাসিডের উৎকট গন্ধে স্থানীয় লোকজন অতিষ্ঠ। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রহীন কারখানাটি থেকে নির্গত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মিলন মিয়া ও আরিফুর রহমান বলেন, পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে প্রতিদিন হাজারো যাত্রী চলাচল করেন। এ ছাড়া সিসা কারখানার পাশে ঘনবসিতপূর্ণ আবাসিক এলাকা। দিনে অ্যাসিড আর রাতে ধোঁয়ার গন্ধ এলাকাবাসীর জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কারখানাটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে বলার পরও কোনো সুফল মিলছে না।

কারখানাটির পূর্ব পাশেই পাটুরিয়া লঞ্চঘাট এবং ফেরিঘাট। এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ নদী পারাপার হয়। এ ছাড়া কারখানাটির পশ্চিম-উত্তরে বসতবাড়ি। অদূরে দাসকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কারখানার অ্যাসিডের ঝাঁজ পায় বিদ্যালয়টির শিক্ষক–শিক্ষার্থীরাও।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা পুরোনো ব্যাটারি ও সিসাভর্তি একটি ট্রাক কারখানার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। সেই ট্রাক থেকে কারখানার শ্রমিকদের কেউ কেউ এসব ব্যাটারিসহ সিসা কারখানার ভেতর নিচ্ছেন। বেশ কয়েকজন শ্রমিক কারখানার ভেতরে কাজ করছেন। কেউ পুরোনো ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে প্লেট (ব্যাটারির ভেতর থাকা পাত) বের করছেন। কেউ ব্যাটারি থেকে অ্যাসিড বের করে সংরক্ষণ করছেন।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানাটিতে দিনের বেলায় পুরোনো ব্যাটারি থেকে প্লেট খোলা ও অ্যাসিড সংরক্ষণের কাজ করা হয়। আর রাত ১০টার পর প্লেটসহ আনুষঙ্গিক জিনিস পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হয়।

কারখানা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ঢাকা ও সাভারের বিভিন্ন স্থান থেকে পুরোনো ব্যাটারি কিনে এনে এখানে সিসা তৈরি করা হয়। কারখানায় ১২ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাঁরা দিনে ব্যাটারি কাটেন আর রাতে গলান। এক টন ব্যাটারির প্লেট পুড়িয়ে ৬০০ থেকে ৬৫০ কেজি সিসা পাওয়া যায়। তবে এখন পুরোনো ব্যাটারি খুব একটা পাওয়া যায় না। উৎপাদিত সিসা তাঁরা দেশের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করে।

এভাবে সিসা তৈরির ফলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির প্রসঙ্গটি তুলে ধরলে সরাসরি কোনো জবাব দেননি কারখানার ব্যবস্থাপক জামাল হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা যে সিসা বানাই, তা সব জায়গায় কাজে লাগে। সিসা ছাড়া মোবাইল অয় না। টিভি, ফ্রিজ, টিন বানাইতেও সিসা লাগে। পরিবেশের ক্ষতি কিছুটা হতে পারে।’

ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির ক্ষতিকর দিক তুলে ধরলেন মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন মোয়াজ্জেম আলী খান চৌধুরী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যেকোনো রাসায়নিকের কালো ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ব্যাটারির বর্জ্য পুড়িয়ে সিসা তৈরি করলে সৃষ্ট ধোঁয়ায় মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগ হতে পারে। মস্তিষ্কের ক্ষতি সাধারণ হতে পারে। এমনকি ধোঁয়ায় কার্বন-মনোক্সাইডের মাত্রা বেশি হলে ক্যানসারও হতে পারে।

স্থানীয় আড়পাড়া এলাকার বিল্টু মিয়া সিসা কারখানাটির মালিক। এ বিষয়ে মুঠোফোনে বিল্টু মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি দাবি করেন, তাঁর দায়িত্ব কারখানাটি দেখভাল করা। প্রকৃত মালিক তাঁর বন্ধু আমিনুর রহমান। আমিনুরের বাড়ি বরিশালে। কারখানা মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মুঠোফোন নম্বর চাইলে বিল্টু বলেন, ‘তিনি (আমিনুর) আপনার সঙ্গে কথা বলবেন না।’

সিসা কারখানাটির বিষয়ে জানা আছে দাবি করে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক শামসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই কারখানাটি খোলা হয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর তাঁরা সরেজমিনে গিয়ে কারখানার কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন।