ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে উপজেলা চেয়ারম্যানের শোচনীয় পরাজয়ের নেপথ্যে

জাহাঙ্গীর আলম
ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম গতবার ৫০ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার তার অর্ধেকের কম ভোট পেয়ে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছে পরাজিত হয়েছেন। এমনকি নিজের এলাকার কেন্দ্রে হয়েছেন তৃতীয়। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না হলেও জাহাঙ্গীরকে মৌন সমর্থন দিয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। এরপরও একজন ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে তাঁর শোচনীয় পরাজয় নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে।

প্রথম ধাপে গোদাগাড়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৬৭ হাজার ৮৮ ভোট পেয়ে উপজেলা যুবলীগের কোষাধ্যক্ষ বেলাল উদ্দিন (সোহেল) বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হন। তিনি উপজেলার দেওপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান ছিলেন। উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে ইউপি চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম পেয়েছেন ২৪ হাজার ৩২৮ ভোট।  

চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে গোদাগাড়ী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল আলম ২১ হাজার ১৩৪, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সুনন্দন দাস ১১ হাজার ৩৫ ও বিএনপি থেকে পদত্যাগ করা সাজেদুর রহমান খান ২ হাজার ২৩০ ভোট পেয়েছেন। গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত উপজেলার ১০৭টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয়।

শোচনীয় পরাজয়ের জন্য জাল ভোট দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বর্তমান চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে একজনকে একাধিক ব্যালটে সিল মারতে দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে তিনি অভিযোগ করেছেন। এ ঘটনা এক জায়গায় নয়; সব জায়গায় ঘটেছে। তা ছাড়া আমার বাড়ি গোদাগাড়ী পৌর এলাকায়। আমি সেখানে তৃতীয় হয়েছি। এটা অবিশ্বাস্য। আমি পেয়েছি ৭৫-৭৬টা করে ভোট আর তাঁরা পেয়েছে হাজারের বেশি ভোট। এটা কি সম্ভব? একজন রানিং চেয়ারম্যান কী এমন খারাপ কাজ করল যে এত কম ভোট পাবে।’

বেলাল উদ্দিন
ছবি: সংগৃহীত

তবে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জেবুননেসা শাম্মী বলেন, নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণের সময় ভিডিও ভাইরালের ঘটনার একটি লিখিত অভিযোগ আসে। ওসি এসে বলেন, ‘একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ এ বিষয়ে মামলা হওয়ার কথা। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ ভালো ছিল। নির্বাচনের সময় সব প্রার্থীর এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কোথাও কেউ এমন অভিযোগ করেননি। এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বলব। কোনো প্রার্থীর আপত্তি থাকলে ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন।’

গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মতিন বলেন, দেওপাড়া ইউনিয়নের নিমতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বাদী হয়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করেছেন। মামলায় ওই যুবককে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এমন ঘটনা আর কোথাও ঘটেনি।

স্থানীয় ভোটাররা বলছেন, প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও রবিউল আলমের বাড়ি একই এলাকায়। পৌর এলাকার ভোট তাঁদের দুজনের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। অন্যদিকে আরেক প্রার্থী সুনন্দন দাস পেয়েছেন ১১ হাজার ৩৫ ভোট। তাঁর বাড়ি পৌর এলাকা-সংলগ্ন মাটিকাটা ইউনিয়নে। আঞ্চলিকতার টানে একজন প্রার্থী যে ভোট পান, তাঁদের তিনজনের মধ্যে তা ভাগ হয়ে গেছে। অন্যদিকে অন্য এলাকার একক প্রার্থী বেলাল উদ্দিন। এ জন্য জাহাঙ্গীর আলম গতবারের মতো ভোট পাননি।

জাহাঙ্গীরের পরাজয়ের পেছনে আরেকটি বিষয় সামনে এসেছে। সব কেন্দ্রে ভোটের আগের রাতে সব প্রার্থীর পোস্টার লাগানো ছিল। মধ্যরাতে বৃষ্টিতে সবার পোস্টার ধুয়ে যায়। পরদিন সকালে ১০৭টি কেন্দ্রে নতুন করে বেলাল উদ্দিন পোস্টার লাগালেও জাহাঙ্গীর ও রবিউলের পোস্টার সব কেন্দ্রে দেখা যায়নি। কোনো কেন্দ্রের সব বুথে জাহাঙ্গীর ও রবিউলের এজেন্ট ছিলেন না।

ভোট চলাকালে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজাবাড়িহাট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে বেলাল ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর পোস্টার নেই। তাঁদের কর্মীও দেখা যায়নি। কয়েকজন ভোটার বলেন, ‘এখানে বেলাল ছাড়া কোনো কথা নেই।’ মাটিকাটা আদর্শ কলেজ কেন্দ্রটিও জাহাঙ্গীরের বাড়ির কাছাকাছি। সেখানেও তার কোনো পোস্টার দেখা যায়নি। স্থানীয় ভোটাররা বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি কম থাকায় সকালে অন্য প্রার্থীর কর্মীরা পোস্টারের খোঁজ নিতে আসেননি।

পরাজিত চার প্রার্থীর ভোট যোগ করলেও বেলাল উদ্দিনের চেয়ে ৮ হাজার ৩৬১ ভোট কম হয়। এই ভোটবিপ্লবের কারণ জানতে চাইলে বেলাল উদ্দিন বলেন, তিনি ইউপি চেয়ারম্যান থাকতে সততার সঙ্গে মানুষের সেবা করেছেন। বিপদে-আপদে মানুষের পাশে ছিলেন। এ জন্য জনগণ তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন।

জাহাঙ্গীরের অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বেলাল উদ্দিন বলেন, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের সব স্তরের কর্মকর্তারা মাঠে ছিলেন। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অন্য কোথাও ঘটলে প্রশাসন ব্যবস্থা নিত। তিনি বলেন, ‘রানিং চেয়ারম্যান পাঁচ বছরে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। এ জন্য ভোটাররা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।’