‘গাড়িটা নৌকার মতো ভাসতেছিল, ড্রাইভাররে বললাম দরজার লক খুলে দিতে’

ভোরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাইয়াপুর ইউনিয়নের পূর্ব জগদীশপুর এলাকায় একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস খালে পড়ে আবদুর রহিমের পরিবারের সাত সদস্য নিহত হন। রহিমের ওমানপ্রবাসী ছেলে আবদুল বাহারকে নিয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন তাঁরা।

সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের একাধিক সদস্যকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাহার উদ্দিন। আজ সকালে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী এলাকার কাসারি বাড়িতেছবি: প্রথম আলো

ঘরে রাখা সাতটি লাশ ঘিরে আহাজারি করছেন স্বজনেরা। তবে বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধ আবদুর রহিমের কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেবল চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল পানি। স্ত্রী, শাশুড়ি, তিন নাতনি ও দুই পুত্রবধূকে হারিয়ে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি।

আজ বুধবার সকালে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী এলাকার কাসারি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় এমন দৃশ্য। এর আগে ভোরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাইয়াপুর ইউনিয়নের পূর্ব জগদীশপুর এলাকায় একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস খালে পড়ে আবদুর রহিমের পরিবারের সাত সদস্য নিহত হন। রহিমের ওমানপ্রবাসী ছেলে বাহার উদ্দিনকে নিয়ে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন তাঁরা।

খালে পড়ে গাড়িটা নৌকার মতো ভাসতেছিল, ড্রাইভাররে বললাম দরজার লক খুলে দিতে। সে লক খুলে দিলে সবাই সাঁতার কেটে বের হতে পারতাম। কিন্তু ড্রাইভার লক না খুলে নিজে একটা জানালা দিয়া বের হইয়া গেছে। আমরা কয়েকজন পরে জানালা ভেঙে বের হইছি। আমার মা-মেয়েসহ বাকিরা গাড়িতেই শেষ।
বাহার উদ্দিন, ওমানপ্রবাসী

নিহত ব্যক্তিরা হলেন—আবদুর রহিমের শাশুড়ি ফয়জুন নেসা (৮০), স্ত্রী খুরশিদা বেগম (৫৫), পুত্রবধূ কবিতা বেগম (৩০) ও লাবনী বেগম (৩০) এবং নাতনি রেশমি আক্তার (১০), মীম আক্তার (২) ও লামিয়া আক্তার (৯)।

চৌপল্লী এলাকার কাসারি বাড়িতে পাশাপাশি সাতটি ঘর। একপাশে চৌচালা একটি টিনের ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস আবদুর রহিমের। সরেজমিনে বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের সাত সদস্য নিহতের খবর পেয়ে ঘরটিতে কয়েক শ মানুষ ভিড় করেছেন। উঠানেও মানুষের জটলা। ঘরে লাশগুলো ঘিরে বেশ কিছু নারী-পুরুষ আহাজারি করছেন। বিছানায় শুয়ে থাকা আবদুর রহিমকে অনেকেই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে কোনো জবাব নেই তাঁর। একপর্যায়ে বিছানা থেকে কোলে করে তাঁকে উঠানে নিয়ে এসে চেয়ারে বসিয়ে দেন কয়েকজন স্বজন।

উঠানে কান্না করতে দেখা যায় আবদুর রহিমের ওমানপ্রবাসী ছেলে বাহারকে। স্বজনদের নিজের দেশে ফেরার দিনে এমন দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন তিনি। বাহার বলেন, ‘আমি ফিরে আসছিলাম সবাইরে বুকে জড়িয়ে ধরতে, অথচ চোখের সামনে সবাইরে হারাই ফেললাম। কারে ছেড়ে কারে বাঁচাব বুঝতে পারি নাই, আমি এখন কারে নিয়ে বাঁচব।’

সড়ক দুর্ঘটনায় সাতজনের মৃত্যুর খবরে ভিড় করেছেন এলাকাবাসী ও স্বজনেরা। আজ সকালে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপালী এলাকার কাসারি বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

বাহার বলেন, ‘গাড়িতে আমার মা, স্ত্রী, মেয়ে সবাই আছিল। গাড়ির মধ্যে নানা কিছু নিয়ে হাসাহাসি করছি সবাই। একসময় মা বলল—তোর জন্য কত অপেক্ষা করেছি, বাপ। কথাটা শেষ হয় নাই, বিকট শব্দের সঙ্গে একটা ধাক্কা খেলাম। এরপর সব ওলটপালট হয়ে গেছে।’

এলাকাবাসী জানায়, তিন বছর পর ওমান থেকে দেশে ফিরেছেন বাহার উদ্দিন। তাই তাঁকে আনতে মা-নানি, স্ত্রী, মেয়েসহ পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে বাহারকে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশে রওনা দেন তাঁরা। এরপর আজ ভোর পাঁচটার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে।

দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাহার বলেন, ‘খালে পড়ে গাড়িটা নৌকার মতো ভাসতেছিল, ড্রাইভাররে বললাম দরজার লক খুলে দিতে। সে লক খুলে দিলে সবাই সাঁতার কেটে বের হতে পারতাম। কিন্তু ড্রাইভার লক না খুলে নিজে একটা জানালা দিয়া বের হইয়া গেছে। আমরা কয়েকজন পরে জানালা ভেঙে বের হইছি। আমার মা-মেয়েসহ বাকিরা গাড়িতেই শেষ।’

গাড়ির চালক ঘুম নিয়ে মাইক্রোবাসটি চালাচ্ছিলেন জানিয়ে বাহার বলেন, ‘কুমিল্লায়ও একবার গাড়িটা দুর্ঘটনায় পড়তে গিয়ে রক্ষা পাইছে। আমরা ড্রাইভাররে বললাম প্রয়োজনে একটু ঘুমিয়ে নিতে। কিন্তু তিনি ঘুম নিয়েই গাড়ি চালাতে গিয়া আবারও দুর্ঘটনায় পড়লেন।’

এলাকাবাসী জানায়, তিন বছর পর ওমান থেকে দেশে ফিরেছেন বাহার উদ্দিন। তাই তাঁকে আনতে মা-নানি, স্ত্রী, মেয়েসহ পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে বাহারকে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশে রওনা দেন তাঁরা। এরপর আজ ভোর পাঁচটার দিকে দুর্ঘটনাটি ঘটে।

স্থানীয় উত্তর জয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বলেন, একই পরিবারের সাত নারী-শিশুর মৃত্যুতে পুরো গ্রামে শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় সবাই মর্মাহত।

দুর্ঘটনার বিষয়ে নোয়াখালী ফায়ার সার্ভিসের চৌমুহনী স্টেশনের কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটিতে চালকসহ ১১ জন ছিলেন। এর মধ্যে দুর্ঘটনার পর চালকসহ ৪ জন বের হয়ে যান। অন্য ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা মাইক্রোবাসের পেছনের সিটগুলোতে ছিলেন। মাইক্রোবাসের চালকের ঘুম ঘুম ভাব থাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে।

আরও পড়ুন