দুই কবজি হারানো সিয়াম ছাড়েননি পড়ালেখা, চাকরি নিয়ে ধরেছেন সংসারের হাল

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির শরীয়তপুর কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে কাজ করছেন সিয়াম খান
ছবি: প্রথম আলো

বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে দুটি হাতের কবজি হারাতে হয়েছিল মেধাবী ছাত্র সিয়াম খানকে (২৩)। পঙ্গুত্ব বরণ করেও থেমে যায়নি জীবন। অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর সাহস তাঁকে টিকিয়ে রেখেছে। কারও বোঝা না হতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে অফিস সহায়ক পদে চাকরি করছেন। পাশাপাশি স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়ালেখা করছেন।

সিয়ামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বিঝারি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ফারুক খান। ২০১৭ সালে নড়িয়া সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন সিয়াম। ওই বছরের ৫ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ে বিঝারি গ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের তার ছিঁড়ে পড়ে যায়। সিয়ামদের বাড়ির কাছে একটি খুঁটি থেকে তার ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে ছিল। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মীরা ওই তার না সরিয়ে সঞ্চালন লাইন চালু করে দেন। ওই তারে জড়িয়ে আহত হন সিয়াম। পরে স্বজনেরা তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁর দুই হাতের কনুইয়ের নিচ থেকে কেটে ফেলে দেন। তাঁকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে পরিবার।

‘দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে? দুটি হাত কেটে ফেলতে হয়েছে সিয়ামের’ শিরোনামে ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর আইনজীবী সিফাত মাহমুদ উচ্চ আদালতে রিট করেন। উচ্চ আদালত বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। এরপর উচ্চ আদালত সিয়ামকে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেন। পরে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন।

সিয়ামের দুর্ঘটনার পর চিকিৎসকেরা ওর আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমরা হাল ছাড়িনি। আমাদের সর্বস্ব দিয়ে লড়ে গেছি।
ফারুক খান, সিয়ামের বাবা

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সিয়ামকে তাদের কার্যালয়ে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আদালতের বাইরে ঘটনাটি মীমাংসা করেন। সিয়ামের পরিবার তাতে রাজি হয়। ২০১৯ সালের ৫ মে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির শরীয়তপুর কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে সিয়ামকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ওই বছর উচ্চ আদালত থেকে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়। আদালতের আদেশে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সিয়ামের দুটি কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। ওই কৃত্রিম হাত দিয়ে কোনো কাজ না করতে পারলেও মাঝেমধ্যে সিয়াম তা ব্যবহার করেন।
২০১৮ সালে সিয়াম নড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ওই কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। চাকরির পাশাপাশি তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সিয়ামের বাবা ফারুক খান একটি জাহাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ছেলের দুর্ঘটনার কারণে দীর্ঘদিন কাজে অনুপস্থিত ছিলেন। পরে চাকরি চলে যায়। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত হন। গ্রামের বাড়িতেও কোনো কাজ করতে পারছেন না। মা নাজমা বেগম গৃহিণী। আর সিয়ামের বড় ভাই স্থানীয় একটি এনজিওর মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেন। মা-বাবা ও ভাইকে নিয়ে সিয়ামের সংসার।

ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিয়ামের দুর্ঘটনার পর চিকিৎসকেরা ওর আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমরা হাল ছাড়িনি। আমাদের সর্বস্ব দিয়ে লড়ে গেছি। চিকিৎসকদের চেষ্টায় ওকে বাঁচাতে পেরেছি। কিন্তু দুটি হাত কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। পঙ্গু ছেলেকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আরও অসহায় হয়ে পড়ি। আমার সেই পঙ্গু ছেলে চাকরি করছে, তার আয়ে সংসার চলছে। ওর স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করে উচ্চশিক্ষিত হবে। সরকারি চাকরি করবে। এমন পরিস্থিতিতেও সে পড়ালেখাটা চালিয়ে যাচ্ছে।’

সিয়াম প্রথম আলোকে বলেন, একটি দুর্ঘটনা তাঁর জীবনের স্বপ্নগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। দুটি হাত নেই, কলম ধরতে পারেন না। সহপাঠী ও শিক্ষকদের সহায়তায় পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে হয়তো সনদ অর্জন করতে পারবেন। কিন্তু জীবনের স্বপ্নগুলোতো আর পূরণ করতে পারবেন না। জীবন চালাতে যাতে কারও ওপর নির্ভর হতে না হয়, এটা ভেবে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে চাকরি করছেন।

নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার পর উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় সিয়ামের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের যেকোনো সমস্যায় এখনো প্রশাসন সঙ্গে আছে।

শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সিয়ামের দুর্ঘটনাটি অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। দুর্ঘটনার পর নানাভাবে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তার পাশে থেকেছে। সিয়াম এখন পল্লী সমিতির পরিবারের সদস্য। একজন ভালো ও বিনয়ী সহকর্মী হিসেবে প্রত্যেকে তাকে ভালোবাসেন, সম্মান করেন। সিয়াম যাতে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারেন, তার উদ্যোগ নেবেন।