এক বছরের কাজ পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি

পাবনার সাঁথিয়ার পাটগাড়ি গ্রামের সড়ক নির্মাণের মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে ফেলে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি তোলা ছবিছবি: প্রথম আলো

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার গাগড়াখালি-সোনাতলা বাইপাস সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচ বছর আগে। এক বছরের মধ্যে সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু যথাসময়ে জমি অধিগ্রহণ না করায় ওই কাজ এখনো শেষ হয়নি। তবে নির্মাণের জন্য মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে রাখায় ও কয়েকটি স্থানে কালভার্ট নির্মাণ করে রাখায় এই সড়ক দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আট কিলোমিটার সড়কের প্রায় অর্ধেক অংশের কাজ শেষ হওয়ার পর দুই বছরের বেশি সময় ধরে বাকি অংশের কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। অসমাপ্ত অংশ দিয়ে একসময় রিকশা-ভ্যান চলতে পারলেও এখন সেখান দিয়ে লোকজনই ঠিকমতো হেঁটেই চলাচল করতে পারেন না। সড়ক নির্মাণের জন্য যেখানে–সেখানে মাটি ফেলায় ও একাধিক কালভার্ট নির্মাণ করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

যখন সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়, তখন আমরা সবাই খুব খুশি হইছিল্যাম। কিন্তু এখন এই সড়ক নিয়্যা আমরা খুব বিপদে আছি।
সাইফুল ইসলাম, কৃষক, পাটগাড়ি

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের পাবনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই ভূমি অধিগ্রহণ ছাড়াই গাগড়াখালি-সোনাতলা বাইপাস সড়কের উন্নয়ন কাজ শুরু হয়। আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যেরে এ সড়কের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৩ কোটি টাকা। সড়ক নির্মাণের কাজ পায় ঢাকার এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজ পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি আগের অপ্রশস্ত সড়কের পাশে মাটি ফেলাসহ কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণের কাজ শুরু করে। কিছু অংশ পাকা করার পাশাপাশি সড়কের বর্ধিত অংশেরও কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু সড়কের বর্ধিত অংশের বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায় জমির মালিকেরা ক্ষতিপূরণের দাবিতে সড়কের কাজে বাধা দেন। জমির মালিকেরা একজোট হয়ে ক্ষতিপূরণের দাবিতে আদালতে মামলা করেন। ফলে সব মিলিয়ে সড়ক নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

সড়ক–সংলগ্ন জমির মালিকেরা জানান, তাঁরাসহ এই এলাকার সবাই চান সড়কের কাজ যেন দ্রুত শেষ হয়। কিন্তু সরকারি বিধিমোতাবেক জমির ক্ষতিপূরণ চান তাঁরা। অথচ ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বা জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই সওজ এ এলাকায় নির্মাণকাজ শুরু করে। তাই তাঁরা একজোট হয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে মামলা করেছেন।

ক্ষতিপূরণ চেয়ে যেসব জমির মালিক মামলা করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফেঁচুয়ান গ্রামের মকবুল হোসেন, সুজন হোসেন, বদিউজ্জামান ও আজিজ খাঁ। তাঁরা জানান, এই গ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়কের পুরোটাই ব্যক্তিমালিকানাধীন। ক্ষতিপূরণ পেলেই তাঁরা মামলা তুলে নেবেন। তবে তাঁরা শুনেছেন, সওজ জমি অধিগ্রহণ বাবদ অর্থ ইতিমধ্যে পেয়েছে। সেই অর্থ জমির মালিকদের মধ্যে দ্রুত বণ্টন করে যাতে সড়কের কাজ শুরু হয় তা তাঁরা চান। কারণ, সড়কের কাজ বন্ধ হয়ে থাকায় অন্তত ২৫ গ্রামের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

সরেজমিন পাটগাড়ি, ফেঁচুয়ান, সোনাতলা ও তেঘরি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা সড়কের কারণে রিকশা ও ভ্যান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এগুলোর চলাচল একেবারেই কমে গেছে। এর পরেও রিকশা-ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সম্প্রতি ফেঁচুয়ান গ্রামের অটোরিকশাচালক দায়েন সরদার (৩৫) দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

এই সড়কের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ পাটগাড়ি গ্রামে পড়েছে। এই অংশে সড়ক ছাড়াই কালভার্ট নির্মাণ করে ফেলে রাখা হয়েছে। কালভার্ট পার হওয়ার জন্য এর দুই পাশে মাটি ফেলা হলেও সেখান দিয়ে ভালোমতো হাঁটা যায় না। বিশেষ করে বৃষ্টি হলে ওই অংশ পিচ্ছিল হয়ে যায়। এ সময় প্রায়ই এখান থেকে লোকজন পড়ে গিয়ে আহত হন।

এলাকাবাসী জানান, আগে মাটির রাস্তা থাকায় ভালোভাবেই হাঁটা যেত। এমনকি রিকশা-ভ্যানও চলত। কিন্তু এখন সড়কের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করায় ও মাঝখানে কালভার্ট তৈরি করে রাখায় রিকশা-ভ্যান চলা দূরের কথা ভালোমতো হাঁটাই যায় না।

পাটগাড়ি গ্রামের কৃষক মো. মোস্তফা বলেন, ‘আগে সুন্দর কইর‌্যা এখান দিয়্যা ফসলের বোঝা নিয়্যা হাঁইট্যা যাব্যার পারত্যাম। কিন্তু এখন বোঝা নিয়্যা কালভার্টে ওঠা যায় না। একবার তো বৃষ্টির মধ্যে কালভার্টের খাড়া রাস্তায় ওঠার সময় আমি নিজেই বোঝা নিয়্যা পইড়্যা গেছিল্যাম।’

একই গ্রামের সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘তিন বছরেরও বেশি সময় ধইর‌্যা এখানে কালভার্ট বানায়া রাখছে। এর জন্য গ্রামের সবাই আমরা খুব কষ্টে যাতায়াত করি। যখন সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়, তখন আমরা সবাই খুব খুশি হইছিল্যাম। কিন্তু এখন এই সড়ক নিয়্যা আমরা খুব বিপদে আছি।’

এদিকে এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এর নির্মাণকাজ শুরু করেছিল, তাদের সঙ্গে সওজ চুক্তি বাতিল করেছে। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও জমি নিয়ে মামলার কারণে নির্মাণকাজের সময় পার হওয়ায় চুক্তিটি বাতিল হয় বলে সওজ সূত্রে জানা গেছে।

সওজের পাবনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মনসুর আহমেদ বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ১৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়ে তা জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ওই টাকায় কিছু জমি অধিগ্রহণ করেছে ও বাকি জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হলেই আবার নির্মাণকাজ শুরু হবে। তবে প্রথম পর্যায়ের ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হওয়ায় ভূমি অধিগ্রহণ শেষে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সড়কটির কাজ শুরু করা হবে।’