বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে ‘খারাপ আচরণ’ করায় ১৫ ঘণ্টা থানাহাজতে কলেজছাত্র

থানা–হাজতে শিক্ষার্থী হাসান আলী। বাইরে অপেক্ষায় তাঁর স্ত্রী শারমিন খাতুন। গতকাল শনিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে রংপুরের কোতোয়ালি থানা প্রাঙ্গণেছবি: প্রথম আলো

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ‘খারাপ আচরণ’ করার অভিযোগে এক কলেজছাত্রকে ১৫ ঘণ্টা থানাহাজতে আটক রাখা হয়েছে। পরে আজ রোববার বেলা একটার দিকে তাঁকে ‘অধর্তব্য’ অপরাধের মামলায় রংপুর মহানগর কোতোয়ালি আমলি আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। বিকেল চারটায় তাঁর জামিন শুনানির কথা রয়েছে।

তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া একজন নাগরিককে বাসা থেকে তুলে এনে ১৫ ঘণ্টা হাজতে আটক রাখায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আটক কলেজছাত্রের নাম হাসান আলী। তিনি রংপুর মডেল কলেজের বাংলা বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। গতকাল শনিবার রাত ১০টার দিকে তাঁকে নগরের শাপলা মোড়ের ভাড়া বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসে কোতোয়ালি থানা-পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ‘খারাপ আচরণ’ করেছেন।

কলেজছাত্রের পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগরের শাপলা মোড়ে কয়েক দিন আগে রফিক আহমেদ নামের একজন শিক্ষক ফেসবুকের একটি ভিডিওতে ‘স্পোকেন ইংলিশ’ শেখাতে ‘শহীদ আবু সাঈদ কোচিং সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেন। রফিক আহমেদের ফেসবুক পেজটি আটক কলেজছাত্র হাসান আলী খুলে দেন বলে অভিযোগ। গতকাল রাত সাড়ে আটটার দিকে শাপলা চত্বর এলাকায় হাসানের ভাড়া বাসায় যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগরের একদল নেতা-কর্মী। তাঁর সঙ্গে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করেন নেতা-কর্মীরা।

গতকাল রাত ১১টার দিকে কোতোয়ালি থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানাহাজতে কলেজছাত্র হাসান আলী। বাইরে তাঁর স্ত্রী শারমিন খাতুন দাঁড়িয়ে আছেন। শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষক রফিক আহমেদের কাছে তাঁর স্বামী ইংরেজি শিখতেন। তিনি (রফিক) একটি কোচিং সেন্টার খুলতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্বামীর কাছ থেকে তিনি কোচিং সেন্টারের ফেসবুক পেজ খুলে নেন। ওই ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিও বানান। তাঁদের (বৈষম্যবিরোধী) ধারণা, কোচিং সেন্টারের পেজ থেকে তাঁরা লাখ লাখ টাকা আয় করেন।

আজ বেলা একটার দিকে শারমিন অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামীকে ভাড়া বাসা থেকে জোর করে থানায় এনে ১৫ ঘণ্টা হাজতে রাখা হয়েছে। তাঁর স্বামীর কোনো দোষ নেই। সামাজিকভাবে তাঁর সম্মানহানি করা হয়েছে।

এদিকে গতকাল রাত একটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মারুফ শহীদ আবু সাঈদের নামে কোচিং সেন্টার খোলার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, নগরের মীরগঞ্জের বাসিন্দা রফিক আহমেদ শহীদ আবু সাঈদের নামে কোচিং সেন্টার খুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন। আবু সাঈদের নামে কোচিং সেন্টার খুলে তাঁকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে প্রচার করা হয়েছে। এতে আবু সাঈদের পরিবারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

তবে জিডিতে কলেজছাত্র হাসান আলীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি আবদুল্লাহ আল মারুফ। এ ব্যাপারে কথা বলতে আবদুল্লাহ আল মারুফের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর মহানগরের আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ গতকাল রাতে বলেছিলেন, ‘আবু সাঈদের নাম ভাঙিয়ে কেউ ব্যবসা করলে আমরা তাঁর বিরোধী। ওখানে কোনো একটি ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। সেটি আমার কাছে বেশি বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে।’ এ ব্যাপারে আজ কথা বলতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রংপুর জেলা ও মহানগর কমিটির আহ্বায়কের মুঠোফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায়।

হাসান আলীর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ জানতে চাইলে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান দাবি করেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে তাঁকে থানায় এনে হাজতে রাখা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা রাত একটা পর্যন্ত থানায় ছিলেন। তাঁরা হাসান আলীর বিরুদ্ধে জিডিতে অভিযোগ না করলেও মৌখিকভাবে ‘খারাপ আচরণ’ করার অভিযোগ করেছেন।

আরও পড়ুন

তবে হাসান আলীর স্ত্রী শারমিন খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী খারাপ আচরণ করেননি; বরং রাতে তাঁদের বাসায় দলবল নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন তোলেন তিনি।

জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) আশিক মাহমুদ বলেন, ‘ছাত্ররা কোচিং সেন্টার যাচাই করতে গিয়েছিল। ‌ছাত্রদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে তাঁরা অভিযোগ দিয়ে থানায় দেয়।’ খারাপ আচরণের অভিযোগ তুলে একজন শিক্ষার্থীকে আটক কতটুকু আইনসংগত প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, পুলিশ তদন্ত করে প্রমাণ পেয়ে তাঁকে থানায় এনেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের আরও পেশাদারির পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল। একজন নাগরিককে এভাবে বাসা থেকে গিয়ে তুলে আনা, তাঁর ও তাঁর পরিবারের সম্মানহানি করার দায়ভার কে নেবে?’