সকালের হাটে হাওরের তাজা তাজা মাছ

বিক্রির জন্য রাখা টাটকা শিং-মাগুরসহ হরেক রকমের মাছ। মৌলভীবাজার সদর উপেজলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুর কালভার্ট এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

‘হাওরের পানি নাইরে হেথায় নাইরে তাজা মাছ/ বিলের বুকে ডানা মেলা, নাইরে হিজল গাছ/ বন্ধু নাইরে তাজা মাছ।’ কাউয়াদীঘি হাওরপারে এক সকালে এই গানটিকেই কেন জানি মনে পড়েছে সবার আগে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান—কী দরদি কথা ও সুরের গানটি সেই কবে গাওয়া হয়েছে। তবু যেন এটা এই মুহূর্তেরই কথা, এই মুহূর্তকে ধরে আছে বুকে।

এখন তো আগের ভাসান হাওর নেই। কোথাও ভরাট হয়েছে। কোথাও দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। পানি ও মাছ তো একই গর্ভের ধন। পানি কম হলে মাছের উৎস মরে যায়, উৎপাদন কমে যায়। হাওরের তাজা মাছের এখন অনেক অভাব। হারানো মাছের জন্য হাওরপারের মানুষের আফসোস, হা-হুতাশ দিনে দিনে বাড়ছে।

আরও পড়ুন

তবু এখনো হাওরে পানি আসে, দেখা মেলে ছোট-বড় নানা জাতের মাছের। এখনো জেলের জালে ছটফট করে, তাজা মাছেরা লাফায়। এখনো অনেকের জীবিকার অন্যতম উপায়, উৎস এই মাছ। এখনো এই মাছের খোঁজে অনেকের রাত কাটে হাওরে, ভোরের আগেই কারও ঘুম ভেঙে যায়। হাওরপারের কোথাও না কোথাও এই তাজা মাছের হাট বসে, তাজা মাছের ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এ রকম হাওরের তাজা মাছের সকালবেলার একটি হাট বসে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুর কালভার্টে। এখান থেকে নানা রকম তাজা মাছ ছড়িয়ে যায় শহরে, গ্রামের দিকে।

হাওর থেকে নৌকা নিয়ে হাটের দিকে ফিরছেন জেলেরা। কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুর কালভার্ট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

গত শুক্রবারের কথা, তখনো ভালো করে সকালের আলো ফোটেনি, ঘুমিয়ে আছে পাড়া। শরতের হালকা ভাঙা মেঘের ভেতর থেকে অনেক দূরে সূর্য একটু একটু করে জাগছে। তার আলো কাউয়াদীঘি হাওরের জলে পড়ে কেমন রুপালি হয়ে উঠছে, তিরতির ঢেউয়ের ওপর চিকচিক করছে। পথের দুই পাশের গ্রামগুলো ঘুমিয়ে আছে তখনো। শুধু কাদিপুর কালভার্টের কাছে অল্পকিছু মানুষের দেখা পাওয়া যায়। তাঁরা সবাই মৎস্য ব্যবসায়ী। তাঁরা হাওরফেরা জেলেদের কাছ থেকে তাজা মাছ কিনে দূরের শহরে যাবেন, কেউ যাবেন গ্রামের দিকে। এ এক অন্য রকম সময়।

আরও পড়ুন

কাউয়াদীঘি হাওরের দিক থেকে ভেসে আসছে একেকটি নৌকা। নৌকাবোঝাই চিংড়ি ধরার পট, যার নাম কিরণবালা। একেকটি নৌকায় অনেকগুলো পট। জেলেরা ফিরছেন, তাঁদের চোখেমুখে আধেক রাত জেগে থাকার ক্লান্তি, অবসাদ। এক-দুই নয়, অনেকগুলো নৌকা ফিরছে কাদিপুর কালভার্টের কাছে। কিছু নৌকায় শুধু জাল, আর নৌকার পাটাতনের জলে রাখা তাজা মাছ। সময় যত গড়িয়ে চলছে, কালভার্টে ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। কালভার্ট এলাকাটি হাটের মতো হয়ে যায়।

বিক্রির জন্য রাখা হাওরের ছোট মাছ। কাউয়াদীঘি হাওরপারের কাদিপুর কালভার্ট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

মাছ ব্যবসায়ী জগদীশ সরকার বলেন, ‘প্রত্যেক দিন সকাল পাঁচটার সময় আইয়া (এসে) ইছা (চিংড়ি) মাছ কিনি (ক্রয় করি)। বেশি কিনি ইছা মাছই। তবে পুটি, ট্যাংরা ছোট মাছ যা পাই—তাই কিনি। সুন্দর সুন্দর মাছ আছে।’ এর সঙ্গে যোগ করেন, ‘দুইজন মাইনসে (মানুষে) ২০-৩০ হাজার টাকার একখান নাও খাটায়, ২০-৩০ হাজার টাকার জাল খাটায়। ইছা মাছ ধরলে এক হাজার, ৮০০ টাকা পার (পাচ্ছে)। অন্য কিছু মারলে (অন্য জাতের ছোট মাছ ধরলে) ২০০-৩০০ টাকা পায়। এর লাগি বেশি ইছা মাছ মারে (ধরে), কোনোরকম পেট বাচার।’

সকালবেলার কয়েক ঘণ্টার হাটে তখন চিংড়ি, পুঁটি, টেংরা, কই, শিং, মাগুর, চ্যাং—এসব মাছ উঠেছে। ডোলার মধ্যে মাছগুলো তখনো তরতাজা, নড়ছে, লাফাচ্ছে। এই হাটে পাইকারি ক্রেতাই বেশি। এরা এই হাট থেকে মাছ কিনে কেউ বড় কোনো শহরে নিয়ে যান। কেউ গ্রামের দিকে ফেরি করে এই মাছ বিক্রি করেন। ক্রেতাদের কাছে হাওরের মাছের চাহিদা বেশি।

স্থানীয় লোকজন বলেন, ফান্দা, বড়ি, রিং জাল, পটসহ বিভিন্ন রকমের জাল দিয়ে জেলেরা মাছ ধরেন। চিংড়ি মাছ ধরতে বিকেলের দিকে হাওরের জলে পট ফেলে রাখা হয়। একই রকম ফান্দা জালও বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে জলের মধ্যে পেতে রাখেন জেলেরা। ভোর রাতের দিকে তাঁরা নৌকা নিয়ে পট ও ফান্দা জালের মাছ সংগ্রহ করতে যান। অন্য জেলেরা সরাসরি জাল নিয়ে রাত তিনটা, সাড়ে তিনটার দিকে হাওরে গিয়ে থাকেন। ভোর রাত পর্যন্ত তাঁরা মাছ ধরেন। ভোর হওয়ার পরপরই তাঁরা নৌকায় পটসহ জাল ও মাছ নিয়ে হাটের দিকে চলে আসেন। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাদিপুর কালভার্টে সকালবেলা এই হাট বসছে। অর্ধশতাধিক জেলে এখানে মাছ নিয়ে আসেন। সকাল পাঁচ-ছয়টা থেকে ক্রেতা-বিক্রেতার আসা শুরু হয়, হাট চলে সকাল প্রায় সকাল নয়টা পর্যন্ত।

আরও পড়ুন

অনেকটা বেলা বেড়েছে। যাঁরা মাছ বিক্রি করে ফেলেছেন, তাঁরা বাড়ি চলে গেছেন। যাঁরা মাছ কিনে নিয়েছেন, তাঁরাও খুচরা বিক্রির জন্য পথ ধরেছেন। চারপাশে মানুষের কোলাহল বাড়ছে। হাটের তখন ভাঙা দশা। সকাল নয়টার পর এই পথে নতুন আসা কারও জন্য অনুমান করা মুশকিল কিছু সময় আগেও এখানে অনেক মানুষ ছিলেন, অনেক মাছ কেনাবেচা হয়েছে, এখানে হাট ছিল।