করতোয়ায় বাঁধ দিয়ে বালুর ব্যবসা ভূমি কর্মকর্তার

করতোয়া নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে বালুর ব্যবসা করছেন রবিউল ইসলাম খান। উজানে বাঁধের কারণে ভাটি অঞ্চলে কৃষকদের সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

ফসলি জমি ঝুঁকিতে ফেলে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। হাঁটুপানি পেরিয়ে নদী পার হচ্ছেন এক ব্যক্তি। গত শনিবার সকালে বগুড়া সদর উপজেলার ধাওয়া কোলা গ্রাম এলাকায়ছবি: সোয়েল রানা

বগুড়া সদর উপজেলায় তেলিহারা এলাকায় করতোয়া নদীতে বাঁধ দিয়ে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। এলাকার প্রভাবশালী রবিউল ইসলাম খান করতোয়ার বুকে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে বালুর ব্যবসা করছেন। দীর্ঘদিন ধরে নদী থেকে বালু তুলে ব্যবসা করলেও কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

রবিউল ইসলাম ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের সার্ভেয়ার হিসেবে টাঙ্গাইলের সখীপুরে কর্মরত। পাশাপাশি প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি নদী থেকে বালু তুলে ব্যবসা করছেন। রবিউলের পক্ষ থেকে তাঁর নিয়োজিত লোকজন বালু ব্যবসা দেখভাল করেন। সাপ্তাহিক ছুটির দুই দিন রবিউল বাড়িতে এসে নিজেই বালু উত্তোলন কার্যক্রম তদারক করেন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করায় বর্ষা মৌসুমে নদী-তীরবর্তী অনেক কৃষকের আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। শুষ্ক মৌসুমে নদীর স্রোতোধারা বন্ধ করে আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়ায় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। বাঁধের কারণে পানির প্রবাহ না থাকায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে ভাটি অঞ্চলে কৃষকদের সেচ কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। তবে অভিযুক্ত রবিউলের দাবি, তিনি নদী থেকে নয়, নিজের পৈতৃক জমি থেকে বালু তুলে ব্যবসা করছেন।

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার গোকুল এলাকার মহাসড়ক-সংলগ্ন ধাওয়াকোলা এলাকায় করতোয়া নদীতে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন চলছে। ছোট ছোট ডিঙিনৌকায় সেই বালু কিছুটা দূরে নদীর তীরবর্তী তেলিহারা এলাকায় নিয়ে জড়ো করা হচ্ছে। নৌকায় বালু পরিবহন নির্বিঘ্ন করতে নদীর বুকে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, করতোয়া নদীর তীরবর্তী জায়গায় তাঁর পৈতৃক ৫০ বিঘা জমি আছে। সেই জমি থেকে বালু তুলে তিনি ব্যবসা করছেন। নদীর সীমানা মনে হলেও বালু উত্তোলন করা জায়গাটি নদীর সীমানা নয় বলে তিনি দাবি করেন। নদীতে বাঁধ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বালু ডিঙিনৌকায় তীরবর্তী স্থানে নিতে হচ্ছে। নদীর উজানে আরও কয়েক জায়গায় আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে অন্য ব্যবসায়ীরা বালু তোলায় তাঁর পয়েন্টে নাব্যতা–সংকট দেখা দিয়েছে। এতে নৌকায় বালু পরিবহন করা যাচ্ছে না।

রবিউল ইসলাম দাবি করেন, নৌকায় বালু পরিবহনের সুবিধার্থে নদীতে পর্যাপ্ত পানি জমিয়ে রাখতে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এটা বেআইনি হলে বাঁধ কেটে ফেলা হবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা বছরই নদী থেকে বালু তোলেন রবিউল। শীতের সময় বালু ব্যবসা আরও জমজমাট হয়। করতোয়া নদী থেকে বালু তুলে ছোট ছোট ডিঙিনৌকায় তীরবর্তী একটি স্থানে নেওয়া হয়। নাব্যতা-সংকটের কারণে এবার শীত মৌসুমে করতোয়ায় পানিপ্রবাহ কমে গেছে। এতে নদীতে নৌকায় বালু পরিবহন বিঘ্নিত হচ্ছে। নদী থেকে লুট করা বালু নির্বিঘ্নে পরিবহন করতে ভাটিতে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে উজানে পর্যাপ্ত পানি জমায় বালু নৌকায় করে তীরবর্তী স্থানে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ট্রাকে বিভিন্ন জায়গায় বালু পাঠানো হয়। এক ট্রাক বালু পরিমাণ ভেদে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জেলা নদী রক্ষা কমিটির নিয়মিত সভায় করতোয়া ও বাঙ্গালী নদী থেকে অবৈধভাবে নির্বিচার বালু লুটের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছিল। সভায় জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবোর) পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, করতোয়া ও বাঙ্গালী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ আছে। প্রশাসন থেকে আশ্বস্ত করার পরও করতোয়া নদীর একাধিক স্থানে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে বালু লুট করার বিষয়টি দুঃখজনক। নদী থেকে বালু লুটকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাপার পক্ষ থেকে প্রশাসনকে লিখিতভাবে অনুরোধ জানানো হবে।

২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে—বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদ-নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক-মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ।

বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নদী থেকে বালু উত্তোলন ও বাঁধ দিয়ে স্রোতোধারা বন্ধ করা—দুটিই আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ ও বাঁধ নির্মাণে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।