মহান মে দিবস
ঝুঁকি নিয়ে জীবিকার সংগ্রাম
নওয়াপাড়া নৌবন্দরে ৫০ হাজার ঘাটশ্রমিক প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে বার্জ, কার্গো ও ট্রলার থেকে মাথায় করে পণ্য নামানোর কাজ করছেন।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদের দুই পারে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে কয়েক শ পণ্যবোঝাই বার্জ, কার্গো ও ট্রলার। বাবুল হোসেন (৩১) এখানকার ঘাটশ্রমিক। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নওয়াপাড়া মহাশ্মশানের পাশে একটি ঘাটে দেখা যায়, নদে নোঙর করা ট্রলার থেকে ৫০ কেজি ওজনের সিমেন্টভর্তি বস্তা মাথায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন বাবুল। অপর একটি সিঁড়ি বেয়ে সেই পণ্য তুলছেন পাশের ট্রাকে। একটু অসতর্ক হলে পা পিছলে নদে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রচণ্ড রোদ ও গরমের মধ্যে তিনি করছেন ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজ।
বাবুল হোসেনের বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের মাদারবাড়িয়া গ্রামে। যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামে তিনি স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। মা-বাবা, স্ত্রী, ভাই ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাবুলের সংসার। মা-বাবা ও ভাইয়েরা থাকেন গ্রামের বাড়িতে।
বাবুল হোসেন বলেন, ‘আট বছর ধরে ঘাটে কাজ করছি। আগে জাহাজ (বার্জ ও কার্গো) থেকে সার ও কয়লা নামাতাম। এখন গম, ডাল, বুট ও ছোলা নামাই। আজ সিমেন্ট নামাচ্ছি। ৫০ কেজির বস্তা মাথায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা এবং সিঁড়ি বেয়ে ট্রাকে ওঠা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তা ছাড়া সব সময় পণ্যের ধুলাবালু শরীরে ঢুকতে থাকে। এতে প্রায়ই শরীর খারাপ হয়। শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা, কাশি, চোখ জ্বালাপোড়া করে। প্রায় প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। সকাল আটটায় কাজ ধরি। কোনো দিন সন্ধ্যা ছয়টা, কোনো দিন সাতটা আবার কোনো দিন রাত নয়টা-দশটা পর্যন্তও কাজ করি। দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পাই। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও পেটের দায়ে এই কাজ করি।’
বাবুল হোসেনের মতো নওয়াপাড়া নৌবন্দরে ৫০ হাজার ঘাটশ্রমিক প্রতিদিন এভাবে ঝুঁকি নিয়ে পণ্যবোঝাই বার্জ, কার্গো ও ট্রলার থেকে মাথায় করে পণ্য নামানোর কাজ করছেন।
আরেক ঘাটশ্রমিক কয়রার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের চৌকুনী গ্রামের আবুল কাসেম (৫৯)। তিনি ২৪ বছর ধরে নওয়াপাড়ায় ঘাটশ্রমিকের কাজ করছেন। পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন নওয়াপাড়ায়। তিনি তিনি বলেন, ‘মাল অনুসারে বস্তার রেটও আলাদা। ১২ মাস কাজ হয়। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করি। কাজটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। শরীর খারাপ হয়। কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে এই কাজ করি।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়লাসহ অন্যান্য পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে শ্রমিকদের শরীরে তিনভাবে ক্ষতিকর ডাস্ট প্রবেশ করে। বিশেষ ধরনের মাস্ক ব্যবহার না করায় সরাসরি মুখ দিয়ে ঢুকছে। এ ছাড়া নিশ্বাসের সঙ্গে এবং লোমকূপের ভেতর দিয়েও শরীরে ডাস্ট প্রবেশ করছে। এতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন তাঁরা। শ্বাসকষ্টসহ ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি পর্যন্ত রয়েছে। সরেজমিনে শ্রমিকদের কোনো ধরনের সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
ছোট্ট উপজেলা শহর নওয়াপাড়া। বিদেশ থেকে আসা বছরে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার আমদানি পণ্য এখানে খালাস হয়। এখান থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে রাসায়নিক সার, কয়লা, খাদ্যশস্য ও পাথর। শুধু আমদানি পণ্য নয়, প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ পণ্যের বড় বাজার নওয়াপাড়া। সব মিলিয়ে নওয়াপাড়া এখন ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসাকেন্দ্র। এই ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে কর্মসংস্থান হয়েছে যশোর, খুলনা, নড়াইল, সাতক্ষীরাসহ কয়েকটি জেলার ৫০ হাজার মানুষের।
নওয়াপাড়ার ওপর দিয়ে পাশাপাশি বয়ে গেছে ভৈরব নদ এবং যশোর-খুলনা রেলপথ ও মহাসড়ক। এই তিন পথ নওয়াপাড়ায় এসে সমান্তরাল হয়েছে মাত্র ১৫০-২০০ মিটার দূরত্বে। এই ত্রিমাত্রিক যোগাযোগের সুবিধায় দেশের অন্যতম বড় বিপণনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে নওয়াপাড়া। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নওয়াপাড়ায় সার, খাদ্যশস্য, রড, পাথর ও সিমেন্ট ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটে। একসময় এটা ছিল খাদ্যশস্য, রড, সিমেন্ট, বালু, পাথর, সার বিপণনের কেন্দ্র। ২০১৬ সাল থেকে সেখানে যোগ হয়েছে কয়লা।
বিদেশ থেকে আমদানি করা সার, বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যশস্য, কয়লা বড় জাহাজে করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে আসে। সেখান থেকে বার্জ ও কার্গোতে তা নওয়াপাড়ায় আনা হয়। ভারত থেকে স্থলপথে আমদানি করা পণ্য রেলে বেনাপোল এবং দর্শনা স্থলবন্দর হয়ে নওয়াপাড়ায় আনা হয়। মৌসুমে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ পণ্যবোঝাই বার্জ ও কার্গো নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদে অবস্থান করে। সেখান থেকে নামানোর পর এসব পণ্য প্রতিদিন স্থলপথে এক হাজারের বেশি ট্রাকে করে এবং নদীপথে বার্জ ও কার্গোতে করে দেশের উত্তর, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নেওয়া হয়। প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার শ্রমিক এসব পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ করেন।
অভয়নগর নওয়াপাড়া পৌর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফাল্গুন মণ্ডল বলেন, ‘ভৈরব নদকে কেন্দ্র করে নওয়াপাড়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য চলে। এখানে ৫০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। প্রতিবছর এক-দুজন শ্রমিক সিঁড়ি থেকে পা পিছলে নদের মধ্যে পড়ে মারা যান। পরে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। আমরা দাবি করে আসছি, প্রতি ঘাটে সিঁড়ির নিচে একটি করে জাল দেওয়ার। এতে শ্রমিকেরা সিঁড়ি থেকে পড়লেও জালের মধ্যে পড়বেন। এ জন্য একটি ঘাটে পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় হতে পারে। কিন্তু ঘাটমালিকেরা সেটি করছেন না।’
ফাল্গুন মণ্ডল আরও বলেন, ভৈরব নদ না থাকলে শ্রমিকদেরও কাজ থাকবে না। নদে পরিকল্পিত ড্রেজিং প্রয়োজন। তা ছাড়া নদের দুই পাড়ে ছয় কিলোমিটার করে ১২ কিলোমিটার এলাকায় গাইড ওয়াল নির্মাণ করলে শ্রমিকদের ঝুঁকি কিছুটা কমবে এবং শ্রমিকদের পণ্য নামাতে কম সময় লাগবে।