হাওরে মাছ বাড়াতে হলে জলাবনগুলো রক্ষা করতে হবে

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের আয়োজনে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মৎস্য খাত’ শীর্ষক তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন সম্প্রতি শেষ হয়। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০টি দেশের গবেষকদের ১৯৩টি গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়েছে। সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়াসহ ১০টি দেশের তিন শতাধিক গবেষক অংশ নেন। সম্মেলনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে সম্মেলনের আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় কুন্ডর সঙ্গে।

মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এই সম্মেলনের সার্থকতা কতটুকু?

মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: সম্মেলনের মাধ্যমে অবশ্যই সার্থকতা আসবে। কারণ, আমাদের মৎস্য খাতে বর্তমানে যতগুলো আলোচিত বিষয় আছে (জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, জলজ দূষণ, হারিয়ে যাওয়া মাছের পুনরুদ্ধার, উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ বাড়ানো, মাছের স্বাস্থ্য) প্রায় সব বিষয়েই গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়েছে। সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণাগুলোর নির্যাস নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমরা দেব। এর ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণী মহল পরিকল্পনা তৈরি করতে পারবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের গবেষকেরা কতটুকু উপকৃত হয়েছেন?

মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে যেসব গবেষক এসেছেন, তাঁরা কী ধরনের গবেষণা করছেন, সেটা আমরা জানতে পেরেছি। আবার তাঁরাও জানতে পেরেছেন, আমরা কী নিয়ে গবেষণা করছি। তাঁদের ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণাগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশের গবেষকেরা জানতে পেরেছেন। ভারত, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যতে সমন্বিতভাবে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা করছি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাংলাদেশের কতজন গবেষক এই সম্মেলনে ছিলেন? দেশে মৎস্য গবেষণায় এই সম্মেলন কতটুকু প্রভাব ফেলবে?

মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় দুই শ গবেষক অংশ নিয়েছেন। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকে একে অপরের গবেষণা নিয়ে নিজস্ব মতামত দিয়েছেন। কিছু বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন গবেষক ও শিক্ষার্থীরা এই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে উৎসাহিত হয়েছেন। জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, মাছের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, সামুদ্রিক মাছ চাষের বিষয়ে উপস্থাপিত গবেষণাগুলোর মাধ্যমে নতুন কিছু গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সিলেট তথা হাওর অঞ্চলের মৎস্য গবেষণা নিয়ে কী কোনো গবেষণাপত্র সম্মেলনে উপস্থাপিত হয়েছে?

মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: সিলেট, সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল মূলত দেশীয় মাছের আঁধার। এ সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় মাছ, উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা উপস্থাপিত হয়েছে। বিভিন্নভাবে হাওর এলাকার পানি দূষিত হচ্ছে। বিশেষ করে, ভারতের মেঘালয় থেকে কয়লা ধোয়া পানি এসে যে দূষণ সৃষ্টি করছে, তা মাছ ও জলজ প্রাণীর ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

এ ছাড়া হাওর অঞ্চলে জলাবনগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা উপস্থাপিত হয়েছে। পর্যটন ও মানবসৃষ্ট কিছু কারণে জলাবনগুলোর ঘনত্ব কমেছে। কিন্তু এ জলাবনগুলো দেশীয় মাছের প্রজননকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে হাওর অঞ্চলে মাছের উৎপাদন বাড়াতে ও বিলুপ্তির হাত থেকে প্রজাতিগুলোকে রক্ষা করতে এই জলাবনগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সিলেটসহ বাংলাদেশে মৎস্য গবেষণা এগিয়ে নিতে সম্মেলনে কী কী পরামর্শ ও সুপারিশ এসেছে?

মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: বাংলাদেশ ও ভারতের আন্তর্দেশীয় পানি দূষণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সেখানে এমন সুপারিশ এসেছে যে দুই দেশের গবেষকদের যৌথ গবেষণার মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ করা যেতে পারে। মৎস্য চাষে বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়েছে, কিন্তু উন্মুক্ত জলাশয়গুলো এখন পর্যন্ত সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন করতে পারছে না, জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

যেহেতু হাওর এলাকাসহ সারা বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে উন্মুক্ত জলাশয় রয়েছে, সেগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন অনেকাংশে বাড়ানো সম্ভব।

উন্মুক্ত জলাশয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। একটি হলো, পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছের অভয়ারণ্য তৈরি করে সেগুলোকে কমিউনিটি বেইজড ম্যানেজমেন্টের আওতায় আনা। দ্বিতীয়টি হলো, নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিলের নাব্যতা ফিরিয়ে আনা।