স্বর্ণের কারিগরদের পেশাবদল

রংপুর নগরের বেতপট্টির ক্রেতাশুন্য একটি স্বর্ণের দোকান। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের তারাগঞ্জের বানিয়াপাড়া গ্রামের অমৃত সাধু (৪৮) স্বর্ণের দোকানের কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন ২৮ বছর। মাস তিনেক আগে তিনি পেশা বদল করে ইজিবাইক ভাড়ায় চালাচ্ছেন। দফায় দফায় সোনার দাম বাড়ায় জীবন চালাতে তিনি এ পেশা বদল করেন।

অমৃত সাধু বলেন, ‘সোনার ভরি লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর মানুষ এখন আর সোনার জিনিসপত্র কিনছেন না। এ কারণে অনেকটা বেকার হয়ে পড়েছেন কারিগরেরা। স্বর্ণ কারিগরদের এখন দুর্দিন চলছে। এতে পাঁচ সদস্যের সংসারে অচলাবস্থা দেখা দেওয়ায় বাধ্য হয়ে ওই পেশা ছেড়ে রংপুর নগরে অটোরিকশা ভাড়ায় চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি।’

শুধু অমৃত সাধুই নন, তারাগঞ্জের স্বর্ণের কারিগর আমিরুল ইসলাম, সফিয়ার রহমান, ইদ্রিস আলী, দীনবন্ধু রায়, বদরগঞ্জের রণজিৎ রায়, বিমল চন্দ্র, তরিকুল ইসলামসহ অনেকেই পেশা বদল করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

অন্তত ১৫ জন স্বর্ণ কারিগরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিন দিন স্বর্ণের লাগামহীন দামে বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জসহ রংপুরে সংকটের মুখে পড়েছে জুয়েলারি ব্যবসা। এতে ক্রেতা কমে যাওয়ায় ব্যবসায় মন্দা নেমে এসেছে। কারিগরেরা হয়ে পড়েছেন অনেকটা বেকার।

বদরগঞ্জের স্বর্ণ কারিগর বিমল চন্দ্র বলেন, জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে সাধারণ মানুষের জীবন চলাই দায় হয়ে পড়েছে। সোনা কেনা হচ্ছে বিলাসিতা। মানুষ জীবন বাঁচাবে নাকি সোনা কিনবে? সোনার যে দাম, তাতে সোনা কেনার টাকাও সাধারণ মানুষের হাতে নেই।

বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন রংপুর জেলা শাখা সূত্রে জানা যায়, বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলায় ৫০টিসহ রংপুর জেলায় সোনার দোকান রয়েছে আট শতাধিক। এর সঙ্গে কারিগর জড়িয়ে আছেন অন্তত আট হাজার। বছরখানেক আগেও জেলায় প্রতি মাসে সোনার জিনিসপত্র বিক্রি হতো অন্তত ১০ কোটি টাকার। মাস ছয়েক ধরে দুই কোটি টাকার জিনিসপত্রও বিক্রি হচ্ছে না।

ক্রেতা নেই। তাইতো বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন রংপুরের তারাগঞ্জের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ী। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

তারাগঞ্জের জুয়েলারি ব্যবসায়ী, ‘সুশান্ত রায় বলেন, এখন ব্যবসা নাই। তিন মাস ধরে ৫০ হাজার টাকার স্বর্ণের জিনিসও বিক্রি হয়নি। খুব বেকায়দায় পড়েছি। কারিগরেরা দোকান ছেড়ে চলে যাচ্ছে।’

বদরগঞ্জের সোনা ব্যবসায়ী মিজু আহম্মেদ বলেন, সোনার ব্যবসায় ধস নেমেছে। কোনো বিক্রি হচ্ছে না। সোনার দাম বাড়তে বাড়তে ভরিপ্রতি লাখ টাকায় ঠেকেছে। বর্তমানে অর্থসংকটে সাধারণ মানুষের জীবন চলছে না। সোনা কিনবে কী দিয়ে!
সরেজমিনে দেখা গেছে, জুয়েলারি দোকানগুলোয় অলস সময় কাটছেন ব্যবসায়ী ও কারিগরেরা। ব্যবসায়িক মন্দায় তাঁরা দুশ্চিন্তায় দিন কাটছেন।

রংপুর নগরের রুমা জুয়েলার্সের মালিক হারুন অর রশিদ বলেন, বর্তমানে ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। এমনও সময় যাচ্ছে ১৫ দিনে এক দিন ব্যবসা হয়। দফায় দফায় দাম বাড়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে সোনা চলে যাওয়া এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে।

রংপুর স্বর্ণ কারিগর হেলেন মিয়া বলেন, একসময় স্বর্ণশিল্পী মানেই ছিল অভিজাত পেশা। আর এখন সেই পেশা সংকটে পড়েছে। বাধ্য হয়ে কারিগরেরা পেশা ছেড়ে দিয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন। অনেকে কৃষিকাজেও ঢুকে পড়েছেন।

বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন রংপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সোনার দাম বাড়ছেই। এখন সোনার ভরি প্রায় লাখ টাকা। সোনার দাম বাড়ায় প্রতিটা জুয়েলারি ব্যবসায়ী আমরা লোকসানের মুখে পড়েছি। অনেক দক্ষ কারিগর কাজের অভাবে পেশা বদল করছেন।’

বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশন রংপুর জেলা শাখার সভাপতি এনামুল হক বলেন, চলতি বছরে ১৭ বার সোনার দাম ওঠানামা করেছে। এতে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে চলে গেছে সোনার জিনিস। স্বর্ণশিল্পকে বাঁচাতে স্বর্ণনীতির পূর্ণ বাস্তবায়নসহ ব্যবসায়ীদের ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়া দরকার।