বাউল জালাল নূরীর কাছে গানই সবকিছু
সেই ছোটবেলায় গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে কলের গান (গ্রামোফোন) বাজত। বিয়েশাদিতে মাইকে বাজানো হতো নানা ঢঙের গান। গাজির গীত হতো, ফকির মেলা (পীর-মুর্শিদি গানের আয়োজন) হতো। এই গানগুলো খুব টানত তাঁকে। সব সময় মনের ভেতর সেসব গানের কথা ও সুর বেজেই গেছে। গান ছাড়া আর কিছুই তাঁকে টানেনি। এরপর ঘরসংসার করেছেন ঠিকই, কিন্তু মন মজে থাকে সেই গানেই।
একরকম সংসারে থেকেই গানপাগল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন মৌলভীবাজারের বাউল জালাল নূরী (৬০)। সংসারের গোছানো ও বৈষয়িক মানুষ তিনি হতে পারেননি। গানকে আশ্রয় করেই সুরের ভেলায় তাঁর দিবানিশি কাটছে।
জালাল নূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবকিছুর ঊর্ধ্বে অইল (হলো) আমার গান। গান গাইলে, বাজনা বাজালেই আমার ভালো লাগে। দুঃখ পাইলেও গান গাই, কানতে অইলেও (কান্না করতে হলেও) গানই গাই। যন্ত্র লইয়া বই (বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসি)। গান ছাড়া আর কোনো কিছুতে আমার লোভ-লালসা নাই।’
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মৌলভীবাজার শহরের নতুন কালীবাড়িসংলগ্ন স্থানে সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সংগীতশিল্পী নির্বেন্দু নির্ধূতের কর্মস্থলে আলাপ হয় জালাল নূরীর সঙ্গে। তিনি তখন বলেন, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মাতারকাপনে তাঁর বাড়ি। ১১ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। পড়ালেখার প্রতি মন ছিল না। মাত্র তিন মাস বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। পড়াশোনার পাঠ ওখানেই শেষ। তাঁর মনে আছে, আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতে গ্রামোফোনে গান বাজানো হতো। সেসব গান কাছে বসে মন দিয়ে শুনতেন। বিয়েবাড়িতে মাইকে গান বাজত। এ গানগুলো তাঁকে খুব টানত। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠানে গাজির গীত, বিভিন্ন স্থানে ফকির মেলার আসরে গিয়ে গান শুনতেন।
জালাল নূরী বলছিলেন, বেহালার তারে কেউ টান দিলেই তাঁর মনটা আনচান করে উঠত। মেলা থেকে খেলনা বেহালা কিনে এনে নিজে নিজে সুরের চর্চা করেছেন, শুনে শুনে গান শিখেছেন। একটা সময় গ্রামের বিভিন্ন গানের আসরে তাঁর ডাক পড়তে থাকে। সারা রাত গান চলত। গান গেয়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পেতেন। তবে পরিবারের লোকজন তাঁর গান গাওয়াকে সহজভাবে নেননি। তাঁর ভাষায়, ‘সংসারের কেউ গান গাওয়া ভালা পায় না। অউ (তাই) ১৯৮১ সালে বাড়ি ছাড়িয়া গেলামগি (ছেড়ে চলে গেলাম)।’
জালাল নূরী তখন সিলেটে চলে যান। সিলেটে ওস্তাদ মুজিব সরকারের কাছে গান শেখা শুরু করেন। তিন বছর সিলেটে থেকে গান শিখলেন। শিখলেন বেহালা, হারমোনিয়াম ও দোতারা বাজানো। ১৯৮৬ সালে সিলেট রেডিওতে তিনি তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। সে বছরই বিয়ে করেন। সংসারী হওয়ার জন্য রোজগার বাড়াতে তিনি প্রবাসী হলেন। তিন বছর ছিলেন সৌদি আরবে আর আড়াই বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে। গান নিয়ে পড়ে থাকায় চাকরি চলে গেলে দেশে ফিরে আসেন। গান লেখেন, সুর দেন ও গান গেয়ে বেড়ান। সংসারে থেকেও সংসারবিবাগি এক বাউল তিনি।
সংগীতশিল্পী নির্বেন্দু নির্ধূত গানপাগল জালাল নূরী সম্পর্কে বলেন, ‘তাঁকে দেখলে বাউলই মনে হয়। বাউলের মূলধারাই তিনি পালন করেন। তিনি বাউলশিল্পী নন, বাউল ঘরানারই লোক।’ এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ গান লিখেছেন বলে দাবি জালাল নূরীর। ‘মনুর সুর’ ও ‘লোকপ্রেম’ নামের তাঁর দুটি বই আছে। এ ছাড়া তাঁর লেখা তিনটি আঞ্চলিক নাটক আছে।
সরকার থেকে জালাল নূরী ২৫ শতাংশ জায়গা পেয়েছেন জানিয়ে বলেন, সেখানে ‘জালাল নূরী বাউল নিকেতন’ নামের একটি গানের ‘আখড়া’ গড়ে তোলার ইচ্ছা তাঁর। এখানে প্রতি বৃহস্পতিবার গানের আসর বসে। সারা রাত গান ও আড্ডায় কেটে যায়। তাঁর অনেক শিষ্য আছেন, যাঁরা তাঁর কাছে গান শিখেছেন ও শিখছেন। জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে গুণীজন সম্মাননা পেয়েছেন ২০১৪ সালে। বছরে একবার সরকার থেকে ১৬ হাজার টাকা শিল্পী ভাতা পেয়ে থাকেন। আজীবন গান নিয়ে থাকতে চাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গান ছাড়া কুনতা (কোনো কিছু) আমার আর ভালা লাগে না। গান লইয়াই (নিয়েই) আমি ভালা আছি।’