সোনাদিয়া দ্বীপে প্যারাবন পুড়িয়ে নতুন চিংড়িঘের

রাতে জ্বলছে সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবন। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ মহেশখালীর প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সোনাদিয়া দ্বীপে নতুন করে অন্তত এক হাজার একরের প্যারাবনের কেওড়া ও বাইনগাছ ধ্বংস করে তৈরি হয়েছে সাতটি চিংড়িঘের। এবার প্রকাশ্যে পেট্রল ঢেলে গাছপালা পুড়িয়ে এই ঘের করা হয়েছে।

এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৩ হাজার একরের বেশি প্যারাবন ধ্বংস করে সেখানে নির্মিত হয়েছিল ৩৭টি চিংড়িঘের। এসব ঘের উচ্ছেদ করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও গত ছয় মাসে তা কার্যকর হয়নি। এখন চিংড়িঘেরের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৪।

কক্সবাজার শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ছোট্ট দ্বীপ সোনাদিয়া। লাল কাঁকড়া, কাছিম ও বিরল পাখির কারণে এই দ্বীপ পরিচিত। সোনাদিয়া দ্বীপটিকে ২০০৬ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। মানে হলো, সেখানকার মাটি, পানি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।

বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্যোগে ঘের তৈরি হলেও এখন স্থানীয় বিএনপি নেতারা এই কাজ করছেন। সরকার পতনের পর গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এসব ঘের তৈরি করা হয়েছে। এসব ঘেরে আগামী জুন মাসে চিংড়ি চাষ শুরু হবে।

প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দ্বীপের প্যারাবন ধ্বংসের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা। বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, পেট্রল ঢেলে আগুনে বনাঞ্চল পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি পাখির আবাসস্থল উজাড় হচ্ছে। দ্বীপের এই প্যারাবনে ২৫০ প্রজাতির মাছ, ১৫০ প্রজাতির শামুক–ঝিনুক, ৫০ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪০ প্রজাতির চিংড়ি, ১৭০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির বালিয়াড়ি উদ্ভিদ ও ১৫ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ, ৩ প্রজাতির ডলফিন, সামুদ্রিক কাছিম, মেছো বাঘ, শিয়াল, সাপ, গুইসাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বসবাস রয়েছে। এখন অর্ধেকের বেশি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

কক্সবাজারের প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সোনাদিয়ার প্যারাবন ধংস হচ্ছে আগুনে। রাতের বেলায় আকাশে ছড়ায় আগুনের শিখা। সম্প্রতি তোলা
ছবি-প্রথম আলো

প্যারাবনে ধ্বংসের চিহ্ন

গত রোববার দুপুরে সোনাদিয়া দ্বীপে গিয়ে দেখা গেছে, দ্বীপের উত্তরাংশে গত বছর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা প্যারাবন ধ্বংস করে যেসব চিংড়িঘের নির্মাণ করেছিলেন, তার আশপাশের প্যারাবান আগুনে পুড়িয়ে অন্তত সাতটি চিংড়িঘের নির্মাণ করা হয়েছে। ওই এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটারজুড়ে তিনটি স্থানে আগুন দেওয়া হয়েছে। আগের নির্মিত চিংড়িঘেরের বাঁধের পাশে যে প্যারাবন ছিল, সেসব এখন বিরান পোড়া জমিতে পরিণত হয়েছে। পুড়ে গেছে জমির ঘাস, তৃণ ও লতাপাতাও। এই তিন এলাকার প্রায় এক হাজার একর প্যারাবনে প্রায় এক লাখ গাছ ছিল বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। এখন আর সেসব গাছের কোনো চিহ্ন নেই। পোড়া গাছের অবশেষ পড়ে থাকতে দেখা গেছে সর্বত্র।

অবৈধ ঘের থেকে উৎপাদিত চিংড়ি ও লবণ বিক্রির টাকা সব মহলে ভাগাভাগি হয় বলে উচ্ছেদে কেউ তৎপরতা দেখান না। যে কারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত থাকছে।
ফজলুল কাদের চৌধুরী, সভাপতি, কক্সবাজার, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-ধরা।

ধ্বংস করা প্যারাবন দেখে এসেছেন বলে জানান মহেশখালীর গোরকঘাটা বন রেঞ্জ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আয়ুব আলী। তিনি বলেন, ভূমিদস্যুরা প্রকাশ্যে প্যারাবন দখল করে চিংড়িঘেরের বাঁধ নির্মাণ করলেও বনকর্মীরা অসহায়। লোকবলের সংকট রয়েছে। তা ছাড়া দখলদারের পক্ষে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী পাহারায় থাকে। তারপরও বনকর্মীরা অভিযান চালিয়ে কিছু ঘেরের বাঁধ কেটে দিয়েছেন। বন বিভাগ মামলা করেছে একটি।

দখলে আগে আওয়ামী লীগ, এখন বিএনপির নেতারা

ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ১ হাজার ১ টাকায় সোনাদিয়ার ৯ হাজার ৪৬৬ দশমিক ৯৩ একর বনভূমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে প্যারাবন পড়েছে অন্তত ৮ হাজার একর। ২০১৭ সালের মে মাসে বেজা উপকূলীয় বন বিভাগের কাছ থেকে তা অধিগ্রহণ করে। কিন্তু কয়েক বছরে বেজা সেখানে ইকো-ট্যুরিজমের কিছুই করেনি। বিশাল প্যারাবন রক্ষার জন্য পাঁচজন নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া অতিরিক্ত জনবলও নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

সরেজমিন অনুসন্ধান ও পরিবেশ সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত চার মাসে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ৩ হাজার একরের বেশি প্যারাবন দখল করে ৩৭টির বেশি চিংড়িঘের তৈরি করেন। এ সময় কেটে ফেলা হয় ছোট ও বড় ২২ লাখের বেশি বাইন, কেওড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। ঘেরের দখল নিয়ে মার্চে দুই দখলদারের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষে ২ জন নিহত হয়েছেন। এখনো প্যারাবন দখল নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে কয়েকজন দখলদার গোষ্ঠী।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীরা জানান, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে বিএনপির নেতা-কর্মী ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা নতুন করে প্যারাবন দখলে নামেন। রাতের আঁধারে প্যারাবনে পেট্রল ঢেলে কেওড়া ও বাইনগাছ ধ্বংস করা হয়।

আরও পড়ুন

সোনাদিয়ার পশ্চিমপাড়ায় প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণ করেন কুতুবজোম ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী। পূর্ব পাড়ায় আরেকটি চিংড়িঘের নির্মাণ করেন স্থানীয় দুই প্রভাবশালী আবুল কালাম ও মোহাম্মদ হোসেন। তাঁদের পাশে চারটি চিংড়িঘের নির্মাণ করেন সোনাদিয়ার ইউপি সদস্য একরাম মিয়া, স্থানীয় প্রভাবশালী ইমতিয়াজ উদ্দিন, আব্দুল মোনাফ, আজিজুল হকসহ কয়েকজন। তাজিয়াকাটার দক্ষিণে আরেকটি চিংড়িঘের নির্মাণ করছেন বিএনপির নেতা আলমগীর চৌধুরীসহ কয়েকজন।

প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির নেতা আলমগীর চৌধুরী বলেন, তিনি চিংড়িঘের নির্মাণের সঙ্গে জড়িত নন। তবে তাজিয়াকাটার ২০ একরের পুরোনো একটি চিংড়িঘের আছে, যা তাঁর বাবার কেনা।

আলমগীর চৌধুরী অভিযোগ করেন, কুতুবজোম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ কামাল ও তাঁর ভাই শেখ আলমগীরের নেতৃত্বে দিনদুপুরে প্যারাবন ধ্বংস করে দুটি চিংড়িঘের নির্মিত হয়েছে। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সময় তৈরি করা ৩৭টি চিংড়িঘেরের মধ্যে শেখ কামালের ৫টি ঘের রয়েছে।

অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে কুতুবজোম ইউপি চেয়ারম্যান শেখ কামাল বলেন, পেট্রল ঢেলে আগুনে প্যারাবন ধ্বংস করে সেখানে কয়েকটি চিংড়িঘের নির্মাণ করেন বিএনপি নেতা আলমগীর চৌধুরী ও তাঁর লোকজন। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘের নির্মাণের কথা অস্বীকার করেন সোনাদিয়ার বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য একরাম মিয়াও।

কক্সবাজারের প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সোনাদিয়ার প্যারাবন ধংস করে চলছে বিএনপি নেতার চিংড়ি ঘের। সম্প্রতি তোলা
ছবি-প্রথম আলো
আরও পড়ুন

উপেক্ষিত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা

গত বছরের ৫ জুলাই প্রথম আলোতে ‘মহেশখালীর সোনাদিয়ায় প্যারাবন কেটে আরও চিংড়িঘের তৈরি’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই সময় প্রায় ১ হাজার ১০ একর প্যারাবন ধ্বংস করে ১০টির বেশি চিংড়িঘের নির্মাণ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।

এর আগের চার মাসে দ্বীপের প্রায় দুই হাজার একর প্যারাবন নিধন করে ৩৭টি চিংড়িঘের নির্মাণ করেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ শতাধিক প্রভাবশালী। এ নিয়ে গত বছরের ১৩ জুন প্রথম আলোতে ‘সংকটাপন্ন সোনাদিয়ায় গাছ কেটে আওয়ামী লীগ নেতাদের মাছ চাষ’ শীর্ষক সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

গত বছরের ২৩ অক্টোবর উচ্চ আদালত সোনাদিয়া ও আশপাশের এলাকায় (ঘটিভাঙ্গা, তাজিয়াকাটা ও হামিদার দিয়া) বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করে অবৈধ চিংড়িঘের উচ্ছেদ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু গত ছয় মাসেও তা কার্যকর হয়নি।

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্যাহ বলেন, ১৭ জানুয়ারি দুটি চিংড়িঘের উচ্ছেদ করা হয়। অবশিষ্ট অবৈধ চিংড়িঘেরগুলো উচ্ছেদ করতে কত টাকার প্রয়োজন, বনায়নের বিপরীতে কী পরিমাণ খরচ লাগবে—তার প্রাক্কলন নির্ধারণের জন্য সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অবৈধ দখলদারদের খসড়া তালিকার কাজ চলছে।

গত ২৪ এপ্রিল কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর দখলচিত্র দেখতে যান অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এ সময় দুই উপদেষ্টা সোনাদিয়ার অবৈধ চিংড়িঘের দ্রুত উচ্ছেদের জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আইনজীবী জাকিয়া সুলতানা বলেন, উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবনের গাছ কেটে চিংড়িঘের তৈরি আদালত অবমাননার শামিল।

পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংগঠনগুলোর মতে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে করা দ্বীপের চিংড়িঘেরগুলো থেকে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার চিংড়ি উৎপাদিত হচ্ছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা-ধরা কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, অবৈধ ঘের থেকে উৎপাদিত চিংড়ি ও লবণ বিক্রির টাকা সব মহলে ভাগাভাগি হয় বলে উচ্ছেদে কেউ তৎপরতা দেখান না। যে কারণে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত থাকছে।