এক বছরে পারাপারে দুর্ভোগ কতটা কমল, কী বলছেন যাত্রীরা

নদীবন্দর ঘোষণার এক বছর পার হলেও সন্দ্বীপের যাত্রীদের দুর্ভোগ কমেনি। ফেরি, সি-ট্রাক ও স্পিডবোট চলাচল করলেও কাদামাটি মাড়ানোর সমস্যা, বিপন্ন রোগী স্থানান্তরে ভোগান্তি এবং নৌপথের নিরাপত্তাহীনতা আগের মতো রয়ে গেছে। সরকারি খননকাজ, পন্টুন নির্মাণ ও সড়ক উন্নয়ন চলছে, কিন্তু শৌচাগার বা যাত্রীছাউনি এখনো তৈরি হয়নি। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সমীক্ষা ও সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া এই রুটে টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।

গত ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ রুটে চলাচল শুরু করে ফেরি কপোতাক্ষছবি: প্রথম আলো

মধ্যযুগে লবণ ও কাঠের তৈরি জাহাজ নির্মাণের জন্য সন্দ্বীপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইউরোপ পর্যন্ত। মধ্যযুগের সেই বিখ্যাত বন্দর সন্দ্বীপের পূর্ব উপকূলের গুপ্তছড়া ঘাটকে ২০২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর উপকূলীয় নদীবন্দর ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এই সিদ্ধান্তে আনন্দে মেতে উঠেছিল প্রাচীন এই দ্বীপের চার লাখ বাসিন্দা। তবে এক বছর পার হলেও যাত্রীদের দুর্ভোগ দূর হয়নি পুরোপুরি।

নদীবন্দর ঘোষণার ফলে ঘাটের মালিকানা নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের অবসান হয়। এ বছরের ২৪ মার্চ ফেরি চলাচল শুরু হয় সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া থেকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে।

সরকারি গেজেট প্রকাশের এক বছর পার হলেও ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী সীমানা জরিপের কাজ শুরু হয়নি বলে জানা গেছে। ভৌগোলিক নানামুখী বিপত্তির মুখে ফেরি চলাচল নির্বিঘ্ন করার চ্যালেঞ্জ দূর করা সম্ভব হয়নি এই এক বছরে। করা হয়নি সম্ভাব্যতা যাচাইসহ গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা। সম্ভাব্যতা যাচাই বা আনুষঙ্গিক সমীক্ষা ছাড়া ফেরি চলাচলের মতো ব্যয়বহুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমালোচনা করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। যাত্রীরা জানিয়েছেন, এই সময়ে ফেরিঘাটের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, দেশের কোনো নদীবন্দরে এক বছরের মাথায় এত কাজ হয়নি যতটা সন্দ্বীপ নদীবন্দরে হয়েছে।

জাহাজ এমভি মালঞ্চের বদলে এখন থেকে চলাচল করবে সি-ট্রাক এসটি নিঝুম দ্বীপ। ৭ ডিসেম্বর গুপ্তছড়া প্রান্ত থেকে তোলা
প্রথম আলো।

যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, ফেরি, সি-ট্রাক, স্পিডবোটের মতো আধুনিক নৌযান চলাচল করলেও কাদামাটি মাড়ানোর দুর্ভোগ, বিপন্ন রোগী স্থানান্তরে ভোগান্তি আর নৌপথের নিরাপত্তাহীনতা রয়ে গেছে আগের মতোই। অথচ নদীবন্দরের ঘোষণা আসার পর নিরাপদ যাতায়াত ও যাত্রীসেবা নিয়ে আশাবাদী হয়েছিলেন বাসিন্দারা।

হয়নি সমীক্ষা

ফেরি চলাচলের আগে সমীক্ষা না হওয়ায় সেটি টেকসই হবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। দেশের প্রথম সাগর পাড়ি দিয়ে ফেরি চলাচল শুরু হলেও ভোগান্তি কাটেনি যাত্রীদের। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মাদ মোসলেম উদ্দিন বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রয়োজনীয় সমীক্ষা ছাড়া এত বড় প্রকল্প শুরু করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তাই হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সমীক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা এই রুটে ফেরি চলাচলের ভোগান্তির দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়। উপযুক্ত সমীক্ষার মাধ্যমে টেকসই সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই রুটে ভোগান্তি দূর হবে না।’

দুর্ভোগের অবসান হয়নি

সন্দ্বীপকে নদীবন্দর ঘোষণার এক বছর পার হলেও এখনো যাতায়াতে আগের মতো দুর্ভোগ রয়ে গেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুর রহমান (৪০) বলেন, ‘নদীবন্দর ঘোষণা হওয়ার পর আমরা আশা করেছিলাম, এই ঘাটে যাতায়াতে আমাদের দুর্ভোগ দ্রুত দূর হবে। কিন্তু এক বছর পার হলেও আমাদের দুর্ভোগ কমেনি। এখনো বর্ষায় লাল বোটে চড়ে আমাদের জাহাজে ওঠানামা করতে হয়। শীতে জেটি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কোমরপানিতে স্পিডবোটে ওঠানামা করতে হয়।’

মো. মনিরুজ্জামান (৩৬) একজন উদ্যোক্তা। কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে তিনি সন্দ্বীপে ফেরেন। প্রথম আলোকে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এখনো মানুষের কাঁধে চড়ে বা কাদাপানিতে ভ্যানে চেপে স্পিডবোটে উঠতে ও নামতে হয়। নদীবন্দর ঘোষণা ও ফেরি চলাচল শুরুর পর আমরা এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম।’

যাত্রীদের এমন দাবির বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক কারণে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ রুটে ফেরি চলাচলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। এটি দেশের অন্য সব নদীবন্দরের মতো নয়।

এক বছরে যা যা হলো

ঘোষিত নদীবন্দর এলাকার গুপ্তছড়া ফেরিঘাটে বর্তমানে খননকাজ (ড্রেজিং) চলছে। এতে চলতি শুষ্ক মৌসুমে নির্বিঘ্নে ফেরি চলাচল করতে পারবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। ফেরি রুটের দুই প্রান্তের ঘাটে দুটি করে পন্টুন বা ওঠানামার সুবিধা গড়ে তোলা হয়েছে। একটি ফেরি (কপোতাক্ষ) উদ্বোধনের পর থেকে নিয়মিত চলাচল করেছে। বর্তমানে ‘এসটি নিঝুম দ্বীপ’ নামের একটি সি-ট্রাক নিয়ে আসা হয়েছে এই রুটে। জাহাজ এমভি মালঞ্চের বদলে এখন থেকে এই সি-ট্রাকই এই রুটে চলাচল করবে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা।

দুই প্রান্তের ঘাট থেকে মূল সড়কে প্রবেশের রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। সামুদ্রিক জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এসব রাস্তা নির্মাণে টেকসই কৌশলের ঘাটতির বিষয়টি সামনে আসে। কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা জানিয়েছেন, অচিরেই এই রুটে সড়ক, পন্টুনসহ বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে।

‘সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রয়োজনীয় সমীক্ষা ছাড়া এত বড় প্রকল্প শুরু করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তাই হয়েছে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন, সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

নেই শৌচাগার, যাত্রীছাউনি

এই রুটের দুই প্রান্তে কেবল দুটি করে পন্টুন স্থাপন ছাড়া আর কোনো স্থাপনা এখনো গড়ে ওঠেনি। গুপ্তছড়া ও বাঁশবাড়িয়া প্রান্তে নেই যাত্রীছাউনি। ফলে ঝড়ে বা তাপে যাত্রীরা ভীষণ ভোগান্তিতে পড়ার কথা বলেছেন। এমনকি দুই প্রান্তে কোনো শৌচাগারও নির্মাণ করা হয়নি। শৌচাগার না থাকাকে যাত্রীরা ‘অবর্ণনীয় দুর্ভোগ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।

ভাটায় ফেরি চলতে না পারা এবং জোয়ারে ফেরি থেকে গাড়ি নামতে গিয়ে ভেসে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। ভাটায় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকলেও জোয়ারে পন্টুনের সংযোগ ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে প্রতিনিয়ত। এ সময় ট্রাক, বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি পানিতে আটকে পড়তে ও নিমজ্জিত হতে দেখা গেছে।

২০২৫ সালের ২৪ মার্চ ফেরি চলাচল আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর আগে ফেরি–রুটের দুই প্রান্তে খননকাজ (ড্রেজিং) করা হয়েছিল। দ্বিতীয় দফা খননকাজ শুরু হয় গত ২৮ অক্টোবর। খননকার্যে এই বিলম্ব যাত্রীদের নাভিশ্বাস বাড়িয়েছে। নাব্যতাসংকটে ফেরি–রুটের গভীরতা কমে যাওয়ায় যানবাহন ও যাত্রী নিয়ে গত ১৪ অক্টোবর কাদামাটিতে আটকে যায় ফেরি কপোতাক্ষ।

২৮ অক্টোবর গুপ্তছড়া প্রান্তে শুরু হয় খননকাজ
ছবি: সংগৃহীত

কী বলছে কর্তৃপক্ষ

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা প্রথম আলোকে এসব ভোগান্তি ও যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে জানিয়েছেন, দুই প্রান্তে শৌচাগার ও যাত্রীছাউনি নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

পন্টুনের সংযোগ সড়ক ডুবে গিয়ে তৈরি হওয়া ভোগান্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই সমস্যা অবিলম্বে দূর হবে। এসব সমস্যা আমরা আগে কোথাও মোকাবিলা করিনি, তাই এসব সমস্যার সমাধানে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও সেসবের বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’