চট্টগ্রামে গার্ডারধস মামলা
৯ বছরেও শেষ হয়নি গার্ডার ধসের বিচার
১৩ জন নিহতের সাড়ে ৯ বছরেও মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন স্বজনেরা।
চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট এম এ মান্নান উড়ালসড়কের গার্ডারধসে ১৩ জন নিহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বিচার সাড়ে ৯ বছরেও শেষ হয়নি। নিয়মিত সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মামলার বিচারকাজ এগোচ্ছে ধীর গতিতে।
এদিকে এত দিনেও মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন নিহতদের স্বজনেরা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তৎকালীন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিচারের আওতায় না আসা নিয়েও হতাশ তাঁরা।
উড়ালসড়কের গার্ডারধসে নিহতদের একজন ছিলেন ২১ বছর বয়সী মো. সাজ্জাদ। তিনি কাঠের ফার্নিচারে ফুলের কাজ করতেন। ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাঁর পরিবার সরকার ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা পান।
সাজ্জাদের বাবা আবদুস সোবহানের প্রশ্ন, তাঁর ছেলের মূল্য ছয় লাখ টাকা হতে পারে না। বেঁচে থাকলে এত দিনে ছয় লাখ টাকার দ্বিগুণের বেশি আয় করতেন সাজ্জাদ। যারা তার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাদের বিচার এখনো পাননি তিনি।
আবদুস সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল আসামিরা আইনের আওতায় না আসায় এখন বিচারের আশাও করি না।’ একই রকম কথা বলছেন নিহত অন্য ব্যক্তিদের স্বজনেরাও।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর বহদ্দারহাটে সিডিএর নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের ১২ ও ১৩ নম্বর গার্ডারধসে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার দুই দিন পর চান্দগাঁও থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম বাদী হয়ে ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এতে সিডিএ তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুস সালাম ও প্রকল্প পরিচালক এ এম হাবিবুর রহমানকে আসামি করা হয়েছিল।
গত সোমবার রাজধানী ঢাকার উত্তরায় চলন্ত প্রাইভেট কারের ওপর গার্ডার পড়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এরপর নতুন করে আলোচনায় এসেছে চট্টগ্রামে ১৩ জন নিহতের ঘটনায় দায়ীদের বিচারের বিষয়টি।
আদালত সূত্র জানায়, চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভুঞার আদালতে ১৩ জন নিহতের মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। সর্বশেষ ১৪ আগস্ট সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। তবে সাক্ষীরা হাজির হননি। পরে আদালত আগামী ৩ অক্টোবর পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেন। এর আগে ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর একজনের সাক্ষ্য গ্রহণের পর প্রায় সাড়ে চার বছরের মধ্যে আর কারও সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। তারপর গত ১৪ এপ্রিল আরেকজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ২৮ সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ধার্য দিনে সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় নিষ্পত্তি হতে সময় লাগছে। আগামী ধার্য দিনে সাক্ষীদের হাজির করে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা রয়েছে।
১৩ জন নিহতের ঘটনায় ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) শহীদুল ইসলাম আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে ফ্লাইওভার নির্মাণের তদারকির সঙ্গে যুক্ত মূল কর্মকর্তাদের কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ থেকে রেহাই দেয় পুলিশ। রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরুদ্ধে নারাজি দেয়। ১৮ জুন নারাজি আবেদন খারিজ করে আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
পিপি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কৌঁসুলির মতামত নেওয়ার কথা থাকলেও তা করেনি পুলিশ। পরে অধিকতর আবেদন করা হলে তা খারিজ করে দেন আদালত। দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা। কিন্তু সবাই আইনের আওতায় আসেনি।
যাঁদের আসামি করা হয়েছে তাঁরা হলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার অ্যান্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমসের তৎকালীন ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, একই প্রতিষ্ঠানের মনজুরুল ইসলাম, আবদুল জলিল, আমিনুর রহমান, আবদুল হাই, মোশাররফ হোসেন, শাহজাহান আলী ও রফিকুল ইসলাম। তাঁরা সবাই জামিনে আছেন।
নিহত ১৩ জনের আরেকজন ইলিয়াস লেদু। উড়ালসড়কের পাশে বহদ্দারহাট ইয়াছিন চৌধুরীর বাড়ির বাসিন্দা তিনি। ইলিয়াসের বড় ছেলে ওমর ফারুক বলেন, মূল আসামিদের বাদ দিয়ে শুধু কর্মচারীদের আসামি করা হয়েছে। কার বিচার চাইবেন?
স্বামী নিহতের বিচার এত দিনেও না হওয়ায় হতাশ ইলিয়াসের স্ত্রী জাহানারা বেগমও। তিনি বলেন, ‘বিচারের আশা করি না এখন আর।’
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, বাড়ি নির্মাণকালে মিস্ত্রির গাফিলতিতে কোনো লোক মারা গেলে বাড়ির মালিক দায় এড়াতে পারেন না। তেমনি সিডিএ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দিলেও তারা দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের প্রাণহানি না ঘটে, তার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত ছিল।