রোজায় যে হোটেল বিনা পয়সায় সাহ্‌রি-ইফতার করায়

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর কলেজ বাজার এলাকার রফিক হোটেল রোজাদারদের ইফতার করায়ছবি: প্রথম আলো

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর কলেজ বাজারের রফিক হোটেলে পবিত্র রমজান মাসে বিনা পয়সায় ইফতার ও সাহ্‌রি খাওয়ানো হয়। হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম আট বছর ধরে রমজান মাসে এ সেবা দিয়ে আসছেন। এবার রমজানেও রফিকের হোটেলে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক ব্যক্তি ইফতারি ও সাহ্‌রি খাচ্ছেন।

অনেকেই ইফতারি ও সাহ্‌রি খেয়ে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে হোটেলমালিক রফিকুল রোজাদারদের কাছ থেকে ইফতারি ও সাহ্‌রির টাকা নেন না। ইফতারিতে থাকে গরুর মাংসের বিরিয়ানি ও সালাদ। সাহ্‌রিতে সপ্তাহে তিন দিন গরুর মাংস থাকে। চার দিন ডিম, মাছ, ভাজি ও ভর্তা খাওয়ানো হয়।

রমজান মাসে রফিকুল ইসলামের এমন উদ্যোগে সবাই খুশি। এ বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি বছরের ১১ মাস ব্যবসা করেন। সেখান থেকে রমজান মাসের জন্য টাকা জমিয়ে রাখেন। জমানো টাকায় রমজানে ইফতারি ও সাহ্‌রি খাওয়ান।

স্থানীয় বাসিন্দা ও কলেজ বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ১৭ বছর আগে রফিকুল ইসলাম কলেজ বাজারের কাঁচা মালামাল পাইকারিপট্টিতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ছোট পরিসরে খাবার হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন। তখন তাঁর হোটেলে গরুর মাংস ও আটার রুটি বেশি চলত। গরুর মাংসের স্বাদের কারণে রফিকুলের হোটেলের সুনাম এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন গরুর মাংসের ভুনা ও রুটি, ভাত খাওয়ার জন্য এখানে চলে আসতেন। এভাবে রফিকুলের ব্যবসা বড় হয়। হোটেলের জায়গাও বড় করেন। এখন তাঁর হোটেলে প্রতিদিন প্রায় এক মণ গরুর ভুনা, আধা মণ আটার রুটি ও দুই মণ চালের ভাত বিক্রি হয়। অন্য দিনের চেয়ে শনি ও বুধবার হাটবারের দিন বিক্রি দ্বিগুণ হয়। ২০১৬ সাল থেকে রফিকুল রমজান মাসে বিনা পয়সায় ইফতারি ও সাহ্‌রি খাওয়ানো শুরু করেন।

গত শুক্রবার ইফতারের সময় রফিকের হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, রফিকের হোটেলের ভেতরে ও বাইরে চেয়ার-টেবিলে ইফতারির প্লেট সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রোজাদারেরা ইফতারির প্লেটের সামনে এসে বসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেলের ভেতরের ও বাইরের সব চেয়ার ভরে যায়। অনেকে জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ইফতার করছিলেন।

ইফতার করতে আসা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়ি পাশের নওগাঁর বদলগাছীর খাদাইল গ্রামে। বাড়ির বাজার করতে এখানে এসেছিলাম। ইফতারের সময় হওয়ায় রফিকের হোটেলে ইফতার করেছি। আমরা একসঙ্গে ৭০-৮০ জন বিরিয়ানি দিয়ে ইফতার করেছি।’

ওই দিন সাহ্‌রির সময় গিয়ে দেখা যায়, হোটেলে ২০ থেকে ২৫ জন সাহ্‌রি খাচ্ছিলেন। হোটেলের মালিক রফিকুল নিজেই সাহ্‌রির খাবার পরিবেশন করছিলেন। তাঁকে আরও দুজন সহযোগিতা করছিলেন। অনেকেই সাহ্‌রি খেয়ে ক্যাশে গিয়ে বিল দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিলেন। তবে হোটেলমালিক কারও কাছ থেকে বিল নেননি।

রফিকের হোটেলে সাহ্‌রিতে সপ্তাহে তিন দিন গরুর মাংস থাকে। চার দিন ডিম, মাছ, ভাজি ও ভর্তা খাওয়ানো হয়
ছবি: প্রথম আলো

এখানে দেখা গোপীনাথপুর বারইল গ্রামের আবদুল খালেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী নিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম সাহ্‌রির সময় ভাত খেতে পারব না। হাসপাতালের একজন নার্স বললেন, সাহ্‌রির সময় কাঁচাবাজারের রফিকের হোটেল খোলা থাকে। সাহ্‌রির সময় হোটেলে গিয়ে অনেক মানুষ সাহ্‌রি খাচ্ছিলেন। আমিও পছন্দমতো গরুর মাংস আর ভাত খাই। খাওয়া শেষে বিল দিতে গিয়ে জানলাম, হোটেলমালিক বিনা টাকায় সাহ্‌রি খাওয়ান। আমার মতো অনেকেই টাকা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু হোটেলমালিক টাকা নেননি। রমজান মাসে ছোট একটি হোটেলের মালিকের এমন উদ্যোগ খুব ভালো লেগেছে।’

আক্কেলপুর কলেজ বাজারের ব্যবসায়ী রাসেল হোসেন বলেন, রফিক হোটেলে আট বছর ধরে রমজান মাসে রোজাদারদের বিনা পয়সায় ইফতারি ও সাহ্‌রি খাওয়ানো হচ্ছে। ভালো কাজের জন্য অনেক বেশি টাকাপয়সা লাগে না। ভালো মন হলেই হয়।

আক্কেলপুর পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমিনুর ইসলাম পল্টু বলেন, ‘রফিক হোটেলের মালিকের এমন মহতী উদ্যোগে আমরা এলাকাবাসী গর্বিত।’

হোটেলের মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ১৭ বছর ধরে হোটেলের ব্যবসা করছি। আল্লাহ তাআলা আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন। রমজানের জন্য টাকা জমিয়ে রাখি। সেই টাকায় পুরো রমজান মাসে ইফতারি ও সাহ্‌রি খাওয়াই। প্রতিদিন ৮ কেজি গরুর মাংস আর ১৬ কেজি চালের বিরিয়ানি রান্না করা হয়। ইফতারিতে বিরিয়ানি ও সালাদ করা হয়। সাহ্‌রিতে সপ্তাহে তিন দিন গরুর মাংস থাকে। এ ছাড়া মাছ-ডিম, ভাজি-ভর্তা থাকে। প্রতিদিন শতাধিক রোজাদার ইফতারি ও সাহ্‌রি খান। রমজান মাসে এমন সেবা দিতে খুব ভালো লাগে। যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন রমজান মাসে এটা করে যাব।’