শীতে বাড়ছে শিশুর মৃত্যু

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুদের চাপ বেড়েছে। এতে শয্যা-সংকটের কারণে মেঝেতে রেখে শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল দুপুরে তোলা ছবিছবি: প্রথম আলো

বরিশালে শীত মৌসুমে তাপমাত্রা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগ শিশু। বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শয্যাসংকটের কারণে শিশুদের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।

বরিশালে কয়েক দিন ধরে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে রয়েছে। গত সোমবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল বরিশালে, ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের শীত ও আয়ে টান পড়ায় কষ্ট সীমাহীন।

আবহাওয়া বিভাগ বলছে, শীতের এই দাপট আরও কয়েক দিন স্থায়ী হতে পারে। এটা শৈত্যপ্রবাহ না হলেও অনুভূত শীত শৈত্যপ্রবাহের মতো তীব্র। উত্তরের কনকনে হিমেল বাতাসের কারণে এবার শীতের অনুভূতি বেশি টের পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধি।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন (এআরআই) বা শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে তিনজনের মৃত্যুর তথ্য আছে। এর মধ্যে ভোলা হাসপাতালে শনিবার রূহি নামের তিন মাস বয়সী এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে নিউমোনিয়ায়। একই রোগে ঝালকাঠিতে আরেক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে চলতি মাসে। এ ছাড়া চলতি মাসে ঠান্ডাজনিত রোগে আরও একজন মারা গেছেন।

বিভাগের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলতি মাসের দুই সপ্তাহে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার রোগী সেবা নিয়েছেন। এ সময়ে মারা গেছে সাত শিশু। বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ বেশি ভোলায়।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চার শিশুবিশেষজ্ঞ প্রতিদিন সেবা দিচ্ছেন চার শতাধিক রোগীকে। শিশু ওয়ার্ডে ৪৫ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি থাকছে পাঁচ গুণের বেশি।

এবার এ অঞ্চলে শীত কিছুটা আগাম এলেও শীতের আচরণ ছিল খেয়ালি। নভেম্বরের শুরুতে এ অঞ্চলে মৃদু শীত অনুভূত হলেও তাপমাত্রা কখনো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, আবার কমে যাওয়ার প্রবণতা ছিল। ফলে দিনে গরম ও শেষরাতে বেশ ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করেছে। কিন্তু নতুন বছরের জানুয়ারির শুরু থেকে শীত কিছুটা বাড়া-কমার মধ্যে থাকলেও ১০ জানুয়ারির পর তা তীব্রতা পায়। এরপর এ অঞ্চলে তাপমাত্রা ১০ দশমিক শূন্য থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও সোমবার তা ৯-এ নেমে যায়। মঙ্গলবার তা ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রিতে উঠলেও অনুভূত শীত শৈত্যপ্রবাহের মতো তীব্রতর। শীতের এমন হেঁয়ালি আচরণের কারণে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব এবার বেশি বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।

মঙ্গলবার দুপুরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেডিসিন ওয়ার্ড, শিশুসহ সব ওয়ার্ড রোগীতে ঠাসা। শয্যা না পেয়ে অধিকাংশ রোগী মেঝেতে আছেন। একইভাবে হাসপাতালের বহির্বিভাগেও রোগীদের ভিড় দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ শিশু।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ওয়ার্ড ছাড়াও বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪০০ শতাধিক শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক রোগী। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডটি ৪৫ শয্যার হলেও সেখানে রোগী আছে কয়েক গুণ বেশি। এ ওয়ার্ডের নার্সিং ইনচার্জ রুনা আক্তার জানান, সোমবার রাতের হিসাব অনুযায়ী তাঁদের ওয়ার্ডে ৯২ জন রোগী ছিল। তবে মঙ্গলবার দুপুরে রোগী ছিল দেড় শতাধিক। ফলে বেশির ভাগ শিশুকে মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছিল।

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলা থেকে চার বছর বয়সী ছেলে জালিস মাহমুদকে নিয়ে ছয় দিন ধরে এ ওয়ার্ডে আছেন মাসুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, ‘এত রোগী যে শয্যা পাওয়া কঠিন। জ্বর, সর্দি-কাশিতে কাহিল ছেলেকে নিয়ে ছয় দিন ধরে এখানে আছি।’

পাঁচ বছর বয়সী সুবাহ জ্বর ও খিঁচুনি নিয়ে তিন দিন ধরে এ হাসপাতালে ভর্তি। ঝালকাঠি জেলার এ শিশুর মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘বাচ্চার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। এ নিয়ে চিন্তায় আছি।’

একই অবস্থা পাঁচ মাসের সাফওয়ানের। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত সাফওয়ানের অবস্থা খারাপ হওয়ায় পাঁচ দিন আগে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলা থেকে নিয়ে এসে তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করেছে পরিবার। শিশুটির মা সাবিনা বেগম বলেন, ‘শয্যা নাই। মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। এতে এত ঠান্ডা যে থাকা দুষ্কর। মনে হয়, আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ব।’

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামান শাহিন প্রথম আলোকে বলেন, শীত মৌসুমের শুরু থেকে ঠান্ডাজনিত রোগী বেড়েছে। শিশু ওয়ার্ডের শয্যার সংখ্যা অপ্রতুল। এরপরও অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শিশু বিভাগে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক উত্তম কুমার সাহা বলেন, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে অথবা যদি ভালো খেতে না পারে, তাহলে শিশুকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সময়ে এসব রোগ থেকে রেহাই পেতে গরম কাপড় ব্যবহার, যতটা সম্ভব ঠান্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলা জরুরি। এ ক্ষেত্রে শিশুদের ঠান্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখা, সেই সঙ্গে ধুলাবালু থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। শৈত্যপ্রবাহ চলাকালে শিশুদের যতটা সম্ভব ঘর থেকে কম বের করতে হবে। ঘরের মধ্যে ঠান্ডা বাতাস যেন না ঢোকে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর আলাদা করে এবার শীতজনিত রোগের বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক হারে। ফলে এটা গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে আলাদাভাবে হিসাব সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

ঠান্ডাজনিত রোগ বিস্তারের পেছনে করোনা অভিঘাতের কোনো যোগসূত্র আছে কি না জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, সেটি সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এমনিতে কমে যায়। তাই যেকোনো রোগে দ্রুত আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে সেসব ব্যক্তির। আর শীতকালে প্রকৃতিগতভাবেই সব মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা লোপ পায়। এটিও একটি বড় কারণ হতে পারে।