চোখের সামনে সুন্দর পদ্মপুকুর, আড়ালে নারীর কষ্টের লড়াই

খুলনার কয়রা উপজেলার নয়ানী গ্রামের এক পদ্মপুকুর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন নারীরাছবি: প্রথম আলো

খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন নয়ানী গ্রামে ভাসছে ৩১১ ফুট দীর্ঘ একটি সেতু। ওপারে মিঠাপানির সরকারি পুকুর, যার বুকজুড়ে ফুটে আছে সাদা পদ্মফুল। চারপাশে লোনাপানির দাপট। ভূগর্ভস্থ পানিও লবণাক্ত। তাই আশপাশের চারটি গ্রামের মানুষ প্রতিদিন সেই ভাসমান সেতু পার হয়ে ওই পুকুর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করেন। বেশির ভাগ পরিবারের জন্য এটি নারীদের নিত্যদিনের কাজ, সংসারের সবকিছু গুছিয়ে তারা ছুটে যান পানির খোঁজে।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই কলস হাতে বের হন নয়ানী গ্রামের রেশমা বেগম। দুই কিলোমিটার দূরের ‘সাদা পদ্মের পুকুর’ই তাঁর পরিবারের পানির একমাত্র উৎস। রেশমা বলেন, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। পুকুরে যাওয়ার রাস্তা একেবারে হারিয়ে যায়। তখন থেকে খাল সাঁতরে বা দূরের চিংড়িঘেরের আল ঘুরে পানি আনতে হতো।

২০০৯ সালের সেই প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পর বদলে যায় নয়ানী গ্রামের ভূগোল। যেখানে ছিল শুকনা মাটির পথ, সেখানে এখন খাল। গ্রামের মানুষ বহু বছর ধরে কাদা মাড়িয়ে বা সাঁতরে পুকুরে যেতেন পানি আনতে। কারও কলস ডুবে যেত, কেউ পিছলে পড়ত, তবু বিকল্প ছিল না।

বহু বছরের সেই দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে উপজেলা প্রশাসন ‘লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক)’ প্রকল্পের আওতায় খালের ওপর ভাসমান সেতু নির্মাণ করে। ১৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ব্যয়ে প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর লোহার অ্যাঙ্গেল ও টিনের শিট বসিয়ে তৈরি করা হয় ৩১১ ফুট দীর্ঘ সেতুটি। ২০২৩ সালের জুনে কাজ শেষ হলে আশপাশের গ্রামগুলোয় দেখা দেয় স্বস্তির হাসি।

কিন্তু সেই হাসি টিকল না ছয় মাসও। লবণাক্ত বাতাসে লোহার সেতুতে মরিচা ধরে, টিনের পাত উঠে যায়, হাতল ভেঙে পড়ে। এখন সেতুর নিচের ড্রামগুলোই শুধু পানিতে ভাসছে, ওপরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

মোল্লাবাড়ি গ্রামের কাকলী বেগম বলেন, ‘আইলার সময় পুকুরি যাবার রাস্তা ভাইঙে খাল হুয়ি গেছে। আগে কলসে পানি ভইরে সাঁতরে ঘরে ফিরতি হতো। পরে সেতু হওয়ায় একটু স্বস্তি পাইলাম। কিন্তু ছয় মাস না যাতিই সেইডাও ভাইঙে গেল। এখন ভাঙা সেতু পার হতিগে মানুষ পড়ি গিয়ে হাত পা কাটি যাচ্ছে।’

লবণাক্ত বাতাসে লোহার সেতুতে মরিচা ধরেছে। এখন সেতুর নিচের ড্রামগুলোই শুধু পানিতে ভাসছে, ওপরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই পথ পাড়ি দিয়ে নারীরা পানি সংগ্রহ করেন
ছবি: প্রথম আলো

একই ক্ষোভ শোনা গেল মহেশ্বরীপুর গ্রামের আবু মুসা শিকারীর কণ্ঠেও। তিনি বলেন, তাঁরা রাস্তা চেয়েছিলেন, কিন্তু সেতু বানানো হলো। টিনের পাত এমন নিম্নমানের ছিল যে ছয় মাসেই উঠে গেছে। ১৮ লাখ টাকায় মজবুত রাস্তা করা যেত। অথচ এখন পুরো টাকাটাই জলে ভেসে গেছে।

বুধবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, খালের জলে দুলছে প্লাস্টিকের ড্রাম, তার ওপর ছিন্নভিন্ন লোহার কাঠামো। সেতু পারাপারের সময় দুলে ওঠে, পা ফসকালেই বিপদ। ওপারে সরকারি ‘মিঠা পানির পুকুর’। পুকুরজুড়ে পদ্মপাতা আর ফুটন্ত সাদা ফুল ফুটে আছে। শান্ত, স্বচ্ছ পানির ওপর সূর্যের আলোয় সেই ফুলগুলো ঝিলমিল করছে।

পুকুরপাড়ে তখন কলস হাতে কয়েকজন নারী পানি তুলছিলেন। নয়ানী গ্রামের অঞ্জনা রায় বলেন, তাঁদের এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বেশি। পূজার সময় পদ্মফুল লাগে, তাই ফুলগুলো তাঁরা যত্নে রাখেন। সেতু নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পারাপারে এখন অনেক কষ্ট। ভাঙা সেতু পার হতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকে পড়ে গিয়ে আহত হন। এখানে একটি স্থায়ী রাস্তা নির্মাণে করলে আর দুশ্চিন্তা থাকত না।

মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারী বলেন, মানুষের কষ্ট কমাতে তাঁরা ভেবেছিলেন, ভাঙা সেতু কাঠ দিয়ে অস্থায়ীভাবে মেরামত করে দেবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন, সেটা সম্ভব নয়। এখন বড় বাজেট দরকার। ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তা ফান্ড পরবর্তী বাজেট পেলেই তাঁরা প্রকল্প নিয়ে নতুন করে সেতুটি সংস্কার করবেন।