রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে এক সাঁওতাল কৃষক ৯ এপ্রিল দুপুরে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, সেচের পানির জন্য হয়রানির কারণে তিনি কীটনাশক পান করেছেন। তবে এ বিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেচের জন্য নয়, অন্য কারণে বিষপান করেছেন ওই কৃষক। এদিকে আজ শনিবার সকালে রাজশাহী থেকে বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিক এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা ওই এলাকা পরিদর্শন করে কিছু চৌচির জমি দেখতে পেয়েছেন।
প্রতিনিধিদল বলছে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা সেখানে অসহায়। তাঁদের জমি এখনো ফেটে চৌচির হয়ে আছে। বাইরে থেকে কেউ পরিদর্শনে গেলে দেখানোর জন্য পানি দেওয়া হচ্ছে।
আত্মহত্যার চেষ্টা করা কৃষকের নাম মুকুল সরেন (৩৫)। তাঁর বাবার নাম গোপাল সরেন। তাঁর বাড়ি উপজেলার বর্ষপাড়া গ্রামে। উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের পাশের ঈশ্বরীপুর ব্লকের একটি প্রকল্পে সাড়ে তিন বিঘা জমিতে তিনি ধান চাষ করেছেন।
সেচের জন্য পানি না পেয়ে কৃষক আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, অভিযোগ ওঠার পর গোদাগাড়ীর ইউএনও সঞ্জয় কুমার মহন্তকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন গোদাগাড়ী উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সবুজ হাসান ও স্থানীয় দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিন। তাঁরা গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান সঞ্জয় কুমার মহন্ত বলেন, তাঁরা মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, পানির জন্য নয়, অন্য কারণে মুকুল সরেন বিষপান করেছিলেন। ওই প্রকল্পে প্রায় ৩০০ বিঘা জমি আছে। প্রায় সব জমিতেই তাঁরা নেমে দেখেছেন, পানি আছে। তিন মাস আগে মুকুল সরেনের স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। এই জন্য তাঁর মন খারাপ থাকতে পারে। তাঁরা যাতে কথায় কথায় বিষ না পান করেন, সে জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া আগে বরখাস্ত হওয়া অপারেটর সাখাওয়াতের কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখা হবে।
আজ সকালে রাজশাহীর গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী, আইনজীবী পারভেজ তৌফিক জাহেদী, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সদস্য মাহমুদ জামাল কাদেরী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ইনভেস্টিগেটর মোস্তফা কামাল ও তাওহীদ আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তাঁরা বর্ষাপাড়া গ্রামের মুকুল সরেনের বাড়িতে যান, তাঁর সঙ্গে কথা বলেন।
মুকুল সরেন প্রতিনিধিদলকে বলেন, সেচের পানির জন্য হয়রানির শিকার হয়ে তিনি বিষ পান করেছেন। স্ত্রীর ব্যাপারে তিনি বলেন, ছয় বছর আগে তিনি স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। নলকূপের অপারেটরকে বাঁচানোর জন্য এখন স্ত্রীর জন্য মন খারাপের কথা বলছে তদন্ত কমিটি।
পরে স্থানীয় সাঁওতালদের নিয়ে প্রতিনিধিদল মাঠে যায়। তারা গিয়ে দেখে, শীতল মার্ডি নামের এক কৃষকের দেড় বিঘা ধানখেতের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। তাঁর স্ত্রী ময়না বিশ্বাস মাঠে গিয়ে জমি দেখান। ময়না বলেন, তাঁর স্বামীকে চার-পাঁচ দিন ধরে পানি দিচ্ছিল না, পরে রাগ করে গতকাল শুক্রবার তাঁর স্বামী পানির লাইন কেটে দিয়েছেন।
প্রতিনিধিদলের সদস্য মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ময়না বিশ্বাসদের দেড় বিঘা জমির ধান উঠলে তাঁদের পরিবারের সারা বছরের খাবারের নিশ্চয়তা হবে। অথচ তাঁদের জমিতে পানি না দেওয়ায় জমি ফেটে গেছে। তাঁদের পরিদর্শনে যাওয়ার কথা শুনে তখনই ওই জমিতে পানি দেওয়া শুরু করেছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, বাইরের কেউ এলে তাঁদের দেখানোর জন্য জমিতে পানি দেওয়া হয় বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা তাঁদের কাছে দাবি করেছেন।
এসব বিষয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে কী আছে, সেটা তিনি দেখবেন। বিষ না খেয়েই যাতে পানি পাওয়া যায়, তিনি সেই ব্যবস্থা করবেন। আর শুধু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নয়, সব কৃষক যাতে পানি পান, সেই ব্যবস্থা তিনি করবেন।
এ ব্যাপারে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ বলেন, ওখানে স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। সেটা তাঁরা মীমাংসা করতে পারবেন না। তিনি ইউএনওকে বলেছেন, সভা করে সেটার নিষ্পত্তি করা যায় কি না, তা দেখতে। আর বিএমডিএর পক্ষ থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা আগামীকাল রোববার প্রতিবেদন জমা দেবে। কারও গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত বছরের ২৩ মার্চ একই স্কিমের চাষি নিমঘটু গ্রামের সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারানডি ও তাঁর চাচাতো ভাই রবি মারানডি সেচের পানি না পেয়ে বিষ পান করেন। এতে অভিনাথ সেদিনই মারা যান। ২৫ মার্চ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রবি। এরপর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনকে বরখাস্ত করা হয়। এবার সেই নলকূপের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হাশেম আলী ওরফে বাবুকে।