হাল্লা পাখিবাড়ি ঘিরে হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্র

এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। এটি দুই বছরে বাস্তবায়ন করবে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় হাল্লাবাড়ির গাছে পাখির আসর। কিচিরমিচির আওয়াজে মুখর চারদিক। গত শুক্রবার সন্ধ্যায়
ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরপারের হাল্লা পাখিবাড়িটি দুই দশকের বেশি সময় ধরে পাখিদের নিরাপদ ঠিকানা। বারো মাস সেখানে ঘর বেঁধে পাখিরা বসবাস করছে। এবার এ হাল্লা পাখিবাড়িকে ঘিরে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও হাওরকেন্দ্রিক ‘ইকোট্যুরিজম’ উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হাকালুকি হাওরের সৌন্দর্যকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে এ উদ্যোগ।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সারা বছরই হাকালুকি পারের হাল্লা পাখিবাড়িতে পাখি থাকে। শীত মৌসুমে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা বাড়ে, বাড়ির গাছপালায় আশ্রয় নেয় পাখিরা। বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক পর্যটক আসেন পাখি দেখতে। কিন্তু এসব পাখি পর্যবেক্ষণ ও সংরক্ষণে পরিবেশ এবং প্রতিবেশবান্ধব কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। এসব বিবেচনা করে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের অর্থায়নে হাল্লা পাখিবাড়িকে ঘিরে ওই এলাকায় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও হাওরকেন্দ্রিক ইকোট্যুরিজম উন্নয়নে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

১৪ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। এটি দুই বছরে বাস্তবায়ন করবে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে পাখিদের বাসা বাঁধা, বিশ্রাম উপযোগী গাছপালা সংরক্ষণ করা। পাখি সংরক্ষণ–সম্পর্কিত গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের সচেতনতা ও সক্ষমতা বাড়ানো হবে। ইকোট্যুরিজম পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনাসহ সুযোগ–সুবিধা বাড়ানো হবে।

এ ছাড়া জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে হাল্লা পাখিবাড়িতে বিভিন্ন ঋতুতে আশ্রিত পাখি প্রজাতির সংখ্যা নিরূপণ করা হবে। পাখিবাড়ির দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণে গাইডলাইন তৈরি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা কমিটি ও কমিউনিটি টহল দল গঠন, প্রশিক্ষণ সহায়িকা তৈরি হবে। প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় জনগণকে ট্যুর গাইডের প্রশিক্ষণ ও বন্য প্রাণী অপরাধনিয়ন্ত্রণ–বিষয়ক প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে।

অন্যদিকে ইকোট্যুরিজম উন্নয়নে পর্যটকদের জন্য আবাসিক কক্ষ, অভ্যর্থনা, সভা ও প্রশিক্ষণকক্ষসহ তিনতলা রিসোর্ট, পুরুষ ও নারীদের পৃথক শৌচাগার, দুটি দৃষ্টিনন্দন প্রবেশ গেট, ফুট ট্রেইল, বসার বেঞ্চ, দিকনির্দেশনামূলক চিহ্ন স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি এখানে জেটি, ইঞ্জিনচালিত ফাইবার বডি বোট, পর্যটকদের লেকে চলাচলের জন্য প্যাডেল বোট থাকবে।

হাল্লা পাখিবাড়ির লোকজন বলেন, প্রায় ২২ বছর আগে হাকালুকি হাওরপারের হাল্লা গ্রামের মনোহর আলী মাস্টারের বাড়িতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এসে আশ্রয় নিতে থাকে। বাড়ির গাছপালায় পাখিরা বসত শুরু করে। শুরুতে পাখির বিষ্ঠার গন্ধে বাড়ির লোকজন বিরক্ত হলেও ধীরে ধীরে তাঁদের কাছে পাখির সব আচরণই সহনীয় হয়ে ওঠে। পাখির কারণে বাড়ির ফলফলাদিসহ বিভিন্ন গাছপালার ক্ষতি হয়েছে। গাছ মরে গেছে। বাড়ির টিনের চাল নষ্ট হয়েছে। সবই বাড়ির মানুষ মেনে নিয়েছেন। একটা সময় পাখিরা বাড়ির লোকজনের প্রতিবেশী হয়ে গেছে। এখন পানকৌড়ি, সাদা বক, ঘুঘু, শালিক, বুলবুলি এ বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা এসে ভিড় করে। পাখি সংরক্ষণের জন্য পাখিবাড়ি জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারও পেয়েছে।

পাখিবাড়ির বাসিন্দা ও পাখি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা শাহরিয়ার আহমদ গত রোববার বলেন, ‘প্রায় ২২ বছর ধরে আমাদের বাড়িতে পাখি থাকে। পাখির বিষ্ঠার গন্ধ, বছর বছর ঘরের চালের টিন বদলানো, গাছপালার ক্ষতি—এসব আমরা মানিয়ে নিয়েছি। গ্রামে অনেক বাড়ি আছে, গাছপালা আছে। কিন্তু অন্য কোথাও পাখি যায় না। বাড়িতেই থাকছে, বাসা বাঁধছে। এককথায় পাখির দখলেই বাড়ি।’

শাহরিয়ার আহমদ আরও বলেন, সারা বছরই পর্যটক আসেন। শীত বাড়ছে, পাখি বাড়বে। দর্শনার্থীও বাড়বে। বাড়িতে কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। সরকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বাড়ি থেকে একটু দক্ষিণে রিসোর্ট করা হচ্ছে। যাতে পাখির কোনো ক্ষতি না হয়। সেখান থেকেই পাখি দেখা যাবে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এবং প্রকল্প পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম গত বৃহস্পতিবার বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও পর্যটকদের আকর্ষণ করতে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে লোকজনকে সচেতন ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনকে যুক্ত করা হবে। প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু করা হয়েছে। বনায়ন করা হচ্ছে।