ছয় খননযন্ত্রে রাতদিন ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর বালু লুট, ভাঙছে তিন গ্রাম

প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতার ছত্রচ্ছায়ায় একটি চক্র বছরের পর বছর সুগন্ধা নদী থেকে বালু তুলছে।

সুগন্ধা নদীর পশ্চিম দিকে খননযন্ত্র দিয়ে তোলা হচ্ছে বালু। উত্তোলিত বালু নেওয়া হচ্ছে নৌযানে করে। গত সোমবার দুপুরে ঝালকাঠি শহরের লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

সরকার নির্ধারিত কোনো বালুমহাল না থাকলেও ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী থেকে অবাধে বালু তুলছে একটি চক্র। নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে এই বালু তোলায় শহর রক্ষা বাঁধসহ তিনটি গ্রাম ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে। শহরের কুতুবনগর বাসস্ট্যান্ডও যেকোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয় লোকজনের।

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০-এর ৪-এর (গ) ধারায় বলা আছে, বালু বা মাটি উত্তোলন বা বিপণনের উদ্দেশ্যে ড্রেজিংয়ের ফলে কোনো নদীর তীর ভাঙনের শিকার হতে পারে, এমন ক্ষেত্রে নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতার ছত্রচ্ছায়ায় একটি চক্র বছরের পর বছর সুগন্ধা নদী থেকে বালু তুলছে। ফলে দেখা দেওয়া ভাঙনে দিয়াকুল, কিস্তাকাঠি ও দেউড়ি গ্রামের মানুষ ফসলি জমিসহ বসতভিটা হারাচ্ছেন। প্রশাসন বলছে, বালু তোলার খবর পেলেই অভিযান চালিয়ে ড্রেজারের (খননযন্ত্র) শ্রমিক আটক, জেল জরিমানা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বালু উত্তোলনের এ চক্র শহরের লঞ্চঘাট এলাকাকেন্দ্রিক। অন্তত ১৬ জনের একটি চক্র বালু তোলার ব্যবসা করে। চক্রের প্রত্যেকের বালু তোলার যন্ত্র রয়েছে। সার্বিক দেখাশোনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন শহর যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল হক খলিফা। এ ছাড়া বালু ব্যবসা করেন জেলা জামায়াতের সদস্য ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর মো. মজিবর রহমানও। তাঁদের কাছ থেকে বালু সংগ্রহ করে শহরের পুকুর, ডোবা ভরাটের ব্যবসা করেন আরও শতাধিক বালু ব্যবসায়ী।

সুগন্ধা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলায় ভাঙনের মুখে পড়েছে তিনটি গ্রাম। গত সোমবার সকালে ঝালকাঠি সদরের দিয়াাকুল গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

কয়েকজন বালু ব্যবসায়ী বলেন, নদী থেকে বালু তোলার জন্য রয়েছে খননযন্ত্র। এই বালু পরিবহনের জন্য রয়েছে নৌযান এবং নৌযান থেকে পুকুর বা জলাশয় ভরাটের জন্য রয়েছে আরেকটি যন্ত্র। জড়িত ব্যক্তিরা সামর্থ্য অনুযায়ী এই তিন ভাগে বিনিয়োগ করেন। প্রথম সারির ব্যবসায়ীদের ছয়টি খননযন্ত্র আছে। অন্যরা বালু বহনকারী নৌযানের মালিক। তাঁরা আবদুল হক খলিফাসহ তিনজনকে প্রতি ঘনফুট বালুর জন্য ২০ পয়সা দেন। এতে দৈনিক প্রায় দুই লাখ টাকা সংগ্রহ হয়।

শহর যুবলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল হক খলিফা এই বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যবসার সঙ্গে এখন জড়িত নই। তবে এদের নেটওয়ার্ক অনেক বড় ও শক্তিশালী।’

অবৈধভাবে বালু তোলার কারণে কিস্তাকাঠি, দিয়াকুল ও দেউড়ি গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। এসব গ্রামের চার শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

সম্প্রতি ঝালকাঠি লঞ্চঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, লঞ্চ টার্মিনাল থেকে পশ্চিম দিকে পাঁচ-ছয়টি খননযন্ত্র দিয়ে নদী থেকে বালু তুলছেন শ্রমিকেরা। অনেক স্থানে নদীর পাড় থেকেও বালু তোলা হচ্ছে। নৌযানগুলো খননযন্ত্রের পাশে ভিড়ছে আর বালু ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন বিকেল থেকে গভীর রাত অবধি এসব ড্রেজারে ওঠানো বালু সকালে শহরাঞ্চলে পাইপ ও ট্রলির মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। লঞ্চঘাট বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, নদী থেকে বালু তোলার কারণে ঝালকাঠি শহর রক্ষার লঞ্চঘাট বেড়িবাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।

ভাঙনে কিস্তাকাঠি, দিয়াকুল ও দেউড়ি গ্রামের চার শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। গত সোমবার সকালে ঝালকাঠি সদরের দিয়াাকুল গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সুগন্ধার ভাঙন এলাকার দিয়াকুল গ্রামে গিয়ে কথা হয় কৃষক মজিদ আলী ও কিস্তাকাঠি গামের গৃহিণী রোকসানা বেগমসহ আরও অনেকের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, সুগন্ধা নদীর লঞ্চঘাট এলাকায় অবৈধভাবে বালু তোলার কারণে কিস্তাকাঠি, দিয়াকুল ও দেউড়ি গ্রাম ভাঙনের কবলে পড়েছে। এসব গ্রামের চার শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আরও দুই শতাধিক বাড়ি ভাঙনের হুমকির মধ্যে রয়েছে। গ্রাম তিনটির প্রায় ৩০০ একর ফসলি জমি ইতিমধ্যে নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে।

দেউড়ি গ্রামের কৃষক কেরামত মিয়া বলেন, ২০১২ সালে নির্মিত গ্রামের একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম-ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ইতিমধ্যে নদীর পানি স্পর্শ করেছে। যেকোনো সময় এটি নদীগর্ভে হারিয়ে যেতে পারে। একটি চক্র বালু উত্তোলন করে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে গেছে। আগে দিনের বেলায় বালু তোলা বন্ধ রাখা হলেও এখন প্রকাশ্যেই হচ্ছে। 

কিস্তাকাঠি গ্রামের সেলিম মিয়া বলেন, বালু তোলার কারণে ইতিমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে কিস্তাকাঠি মসজিদ ও খেয়াঘাটের পার্শ্ববর্তী দিয়াকুলের মসজিদ, মাদ্রাসা ও খেয়াঘাট।

সুগন্ধা নদীর পশ্চিম দিকে খননযন্ত্র দিয়ে তোলা হচ্ছে বালু। গত সোমবার দুপুরে ঝালকাঠি শহরের লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

জানতে চাইলে ঝালকাঠি শহরের লঞ্চঘাট এলাকার ড্রেজারমালিক স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী সুলতান হোসেন বলেন, ‘প্রশাসন আমাদের বাধা দেবে কেন! তাদের সরকারি উন্নয়নকাজে যে বালু লাগে, তা পাবে কোথায়? আমরাই তো তাদের এই বালু দিয়ে সহায়তা করি। এখন স্থানভেদে নিচে ৫ টাকা, ওপরে ১০ টাকায় প্রতি ঘনফুট বালু বিক্রি করছি। আমি ছাড়াও অনেকের ড্রেজার আছে। এতে খরচ আছে। তাই বালুর ফুটপ্রতি খরচ বেশি পড়ে। আমাদের এ কাজ বন্ধ করলে সব উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে যাবে।’

সুগন্ধা নদীর কোনো অংশেই সরকারিভাবে বালুমহাল ঘোষণা করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ঝালকাঠি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনুজা মণ্ডল। তিনি বলেন, তারপরও রাতের আঁধারে বালু তোলা হয়। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। কোনোভাবেই বালু উত্তোলনকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না। এর জন্য একাধিক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।