কোনো বন্ধু নেই, নিজের মতো থাকতেন নিখোঁজ পল্লিচিকিৎসক সেলিম

মো. সেলিম হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

সাত দিন আগে নিখোঁজ হওয়া যশোরের পল্লিচিকিৎসক মো. সেলিম হোসেনের (৪৫) এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে তাঁর স্বজনদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে গতকাল মঙ্গলবার যশোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় যশোর সদর উপজেলার খড়কি এলাকায় নিজ চেম্বার থেকে তাঁকে তুলে নেওয়ার কথা বলেন স্বজনেরা। এ ঘটনায় ৩ ফেব্রুয়ারি যশোর কোতোয়ালি থানায় একটি অভিযোগ করেন সেলিমের স্ত্রী নাজমা খাতুন। কিন্তু অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়নি। তবে আজ বুধবার বিকেলে সেলিম নিখোঁজের বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (ডায়েরি) নথিভুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করছে কোতোয়ালি থানা-পুলিশ। সঙ্গে ছায়া তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ ছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে তৎপর আছেন।

সরেজমিন ও প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেলিমকে যে দোকান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি শহরের খড়কি এলাকার গাজীর বাজারের শেষ মাথায় অবস্থিত। সাইনবোর্ডবিহীন একটি ঘরে বসে সেদিন সন্ধ্যায় সেলিম রোগীর ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছিলেন। অতর্কিতে কয়েকজন ব্যক্তি একটি মাইক্রোবাস নিয়ে সেখানে গিয়ে সেলিমকে তুলে নিয়ে যান।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, মাস দুয়েক আগে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন সেলিম। ওই বাজারে সেলিমের কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। কোনো সামাজিক কার্যক্রমেও তিনি যুক্ত ছিলেন না। তিনি নিজের মতো থাকতেন।

সেলিমের চেম্বারের পাশের মুদিদোকানটা মেহেদী হাসানের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বছর পাঁচেক আগে বাজারে তাঁর একটি চেম্বার ছিল। এর মধ্যে তাঁকে আর বাজারে দেখা যায়নি। হঠাৎ দুই মাস আগে তাঁর শ্বশুরের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে তিনি চেম্বার শুরু করেন। শুক্র ও শনিবার চেম্বার বন্ধ থাকে। প্রতিদিন বিকেলে অনেক রোগী আসেন তাঁর চেম্বারে। তাঁর কোনো বন্ধুবান্ধবকে কখনো দেখেননি। সেভাবে কারও সঙ্গে গল্প বা আড্ডা দিতেও দেখেননি। তিনি নিজের মতো থাকতেন।

বাজারের আরেকজন পল্লিচিকিৎসক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা গ্রাম্য ডাক্তার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। সেলিম ভাই একটু সরল-সোজা মানুষ। সেদিন তাঁর ঘরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয় দিয়ে ৮-১০ জন মানুষ এসে তাঁকে তুলে নিয়ে যায়। কারা, কী কারণে তাঁকে নিয়ে গেছে সেটা জানি না। বিষয়টি নিয়ে আমরা খুব উদ্বেগের মধ্যে আছি।’

খড়কি গাজীর বাজার এলাকার অদূরে খোলাডাঙ্গা গ্রামের মসজিদের পাশেই সেলিমের পৈতৃক ভিটা। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা, ‘রিনা মেডিকেল’। তাঁর প্রথম স্ত্রী আনজিরা খাতুন বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ করছেন। তাঁর প্রতিবন্ধী একটি ছেলে বাড়ির আঙিনায় বসে আছে।

সেলিমের স্ত্রী আনজিরা খাতুন বলেন, তিন বছর আগে সেলিম দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এখন তিনি স্থায়ীভাবে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গেই থাকেন। তবে দিনের কোনো এক সময়ে এ বাড়িতে এসে ঘুরে যান। সংসার খরচের টাকা দেন। কী কারণে, কারা তাঁকে তুলে নিয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছেন না। এলাকায় তাঁর তেমন কোনো বন্ধুবান্ধব নেই।

পল্লিচিকিৎসককে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে স্বজনদের সংবাদ সম্মেলন। মঙ্গলবার দুপুরে যশোর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

সেলিমের দ্বিতীয় স্ত্রী নাজমা খাতুনও পল্লিচিকিৎসক। তাঁরা দুজনে মিলে দুটি চেম্বার চালান। অন্য চেম্বারটি শহরের বেজপাড়া তালতলা এলাকায়। দুজনের আয়েই দুটি সংসার চলে।

নাজমা খাতুন বলেন, শহরের চাচড়া ডালমিল এলাকায় গ্লোবাল অলটারনেটিভ মেডিকেল ইনস্টিটিউট নামের গ্রামের চিকিৎসকদের ডিপ্লোমা কোর্সসংক্রান্ত তাঁদের একটি প্রতিষ্ঠান আছে। তিনি ও সেলিম ওই প্রতিষ্ঠানটি চালান। শুক্র ও শনিবার ওই প্রতিষ্ঠানে পাঠদান করা হয়। ওই প্রতিষ্ঠান ও চেম্বার নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন। তিনি ছাড়া সেলিমের তেমন কোনো বন্ধু নেই।

সেলিম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক (এসএসসি) পাস করে পল্লিচিকিৎসা–সংক্রান্ত একটি ডিপ্লোমা কোর্স করে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন। তিনি গ্রাম্য ডাক্তার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সহকারী সাধারণ সম্পাদক।

নাজমা খাতুন বলেন, ‘সাত দিনেও স্বামীর কোনো হদিস পেলাম না। দুটি পরিবার নিয়ে আমরা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছি। আজও বিষয়টি নিয়ে যশোর কোতোয়ালি থানায় গিয়ে উপপরিদর্শক শেখ জুবায়েরের সঙ্গে কথা বলেছি।’

আরও পড়ুন

উপপরিদর্শক শেখ জুবায়ের বলেন, সেলিম নিখোঁজ হওয়ার পর স্বজনেরা ৯৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করলে কোতোয়ালি থানায় একটি অভিযোগ আসে। ওই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার দিন একটি নম্বর থেকে সেলিমের কাছে চারবার ও তাঁর স্ত্রী নাজমা খাতুনের কাছে দুবার কল আসে। ওই ফোনকলের সূত্র ধরে তদন্ত করা হয়। সেখানে ওষুধসংক্রান্ত বিষয়ে কথোপকথন ছিল। উচ্চতর তদন্তের জন্য পিবিআই ও পুলিশের সমন্বয়ের এখন তদন্ত চলছে। আজ নিখোঁজের বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি জিডি রেকর্ড করা হয়েছে।