সবার দানে সুন্দর শহর

সড়কের জন্য জায়গা ছেড়েছে নগরবাসী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। প্রশস্ত হয়েছে জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা সড়ক ও ফুটপাত। সম্প্রতি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ এলাকায়ছবি: আনিস মাহমুদ

জমির হিস্যা নিয়ে লাঠালাঠি থেকে রক্তারক্তি—কত কীই–না হয়। আপনজন হয় পর। চলে নানা ষড়যন্ত্র, কূটচালের খেলা। আর জমিজমা নিয়ে বছরের পর বছর মামলা–মোকদ্দমার ঘানি টানার অসংখ্য নজির আছে। প্রাণ থাকতে এক টুকরা জমি ছাড়তে চান না কেউ। এই বাস্তবতায় মুদ্রার উল্টো পিঠও কিন্তু আছে।
সিলেট নগরে কোনো রকম জোরজবরদস্তি ছাড়াই লোকজন বাড়ির পাশের জমি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিচ্ছেন। কেউ ছেড়েছেন বাড়ির ফটকের সামনের জায়গা, কেউ বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ভেঙেও জায়গা দিয়েছেন। সরু রাস্তা ও নালা প্রশস্ত করতে সিটি করপোরেশনকে নিজের জমি ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা। নগরবাসীর এমন উদারতায়, তাঁদের দানের বিনিময়ে পাওয়া গেছে চওড়া সব রাস্তাঘাট আর ছিমছাম একটি শহর।

সড়কের জন্য ছেড়ে দেওয়া জায়গা ও দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন নগরের কদমতলী এলাকার মো. লুলু মিয়া
ছবি: প্রথম আলো

এমন দু–চারজন নয়, প্রায় ১৩ হাজার বাসিন্দা স্বেচ্ছায় জমি দান করেছেন। গত ১০ বছরে বাসিন্দারা যে পরিমাণ জমি দান করেছেন, তার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ তার উদার নাগরিকদের এমন অনন্য দানের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ১৩ হাজার বাসিন্দার প্রত্যেককেই প্রশংসাপত্র দিচ্ছে সিটি কর্তৃপক্ষ।
এমন উদ্যোগ সারা দেশের জন্য বড় একটা দৃষ্টান্ত—মন্তব্য করে সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, কবি ও গবেষক মোস্তাক আহমাদ দীন প্রথম আলোকে বলেন, নগরবাসীর স্বেচ্ছায় জায়গা দান করেছেন বলেই সিটি কর্তৃপক্ষ রাস্তাগুলো সম্প্রসারণ করতে পেরেছে। এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এতে নগরবাসীর চলাচলের পথ সুগম হয়েছে। বিষয়টা ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ ছাড়া সিটি কর্তৃপক্ষ সব ভূমিদাতাকে এখন যে প্রশংসাপত্র দিচ্ছে, এতে নগরের অন্য বাসিন্দারাও ভবিষ্যতে জায়গা দিতে উৎসাহী হবেন।

উদ্যোগের নেপথ্যে

বছর দশেক আগেও সিলেট শহরের রাস্তাঘাট ছিল অপ্রশস্ত আর সরু। নগরায়ণের জাঁতাকলে যানবাহন বাড়ে, বাড়ে যানজটও। সমাধানে এগিয়ে আসে সিটি করপোরেশন। রাস্তা, নর্দমা প্রশস্তকরণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সরু সড়কের পাশে করপোরেশন বা সরকারের কোনো জমি তো নেই। সড়কের দুই পাশের বেশির ভাগ জমি ব্যক্তিমালিকানার। আর তাই চওড়া সড়ক করতে জমি কেনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু জমি কেনার পর্যাপ্ত টাকা ছিল না সিটি কর্তৃপক্ষের হাতে।
এদিকে ছোট ছোট রাস্তায় অসহনীয় যানজটে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। শেষে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বিভিন্ন সভা–সমাবেশে নগরবাসীর কাছে জমি চেয়ে আবেদন জানালেন। যখন যে সড়ক প্রশস্ত করা দরকার, কাউন্সিলরদের নিয়ে সে এলাকায় গিয়ে বাসিন্দাদের অনুরোধ করলেন।

আগের থেকে চওড়া হয়েছে সড়ক। সম্প্রতি জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা-আম্বরখানা সড়কের জিন্দাবাজার এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বিনা মূল্যে ভূমিদানের ঘটনা সম্পর্কে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী (৭ নভেম্বর আরিফুলের মেয়াদ শেষ। ৮ নভেম্বর থেকে দায়িত্ব নেবেন নবনির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী) প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল–মতের ঊর্ধ্বে উঠে নাগরিকেরা তাঁদের হাজার হাজার কোটি টাকার মূল্যের জমি বিনা পয়সায় উন্নয়নের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁদের এই বিরল দৃষ্টান্ত সিলেট সিটি করপোরেশনের অগ্রযাত্রায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’
সড়ক প্রশস্ত করার জন্য সিলেটে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁদের সম্পত্তি ছেড়ে দেওয়ার নজির আছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তাঁদের পৈতৃক বাড়ির কিছু জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রথম আলোতে ‘সিলেটে সড়কের জন্য জায়গা ছেড়ে দিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিবার’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়।  

কয়েক হাজার কোটি টাকার জমিদান

সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্ধিত ১৫টিসহ বর্তমানে সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড আছে ৪২টি। তবে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ হয়েছে পুরোনো ২৭টি ওয়ার্ডে। আরিফুল হক ২০১৩ সালে প্রথম দফা মেয়র হওয়ার পর রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ শুরু হয়। পাড়া-মহল্লায় মানুষ ২ থেকে সর্বোচ্চ ৫ ফুট পর্যন্ত জায়গা ছেড়েছেন। এ পর্যন্ত নগরের প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার বাসিন্দা নিজেদের জায়গা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছেন। এসব জায়গায় ২০০টি রাস্তা ও নর্দমা প্রশস্ত করা হয়েছে। এসব জায়গা এবং জায়গায় থাকা স্থাপনার আনুমানিক দাম ১২ হাজার কোটি টাকা।
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দুই পাশে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার কারণে অনেক রাস্তা আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ প্রশস্ত হয়ে গেছে। জায়গা দানের বিষয়টি সিলেটবাসীর বিশাল উদারতার পরিচয়।

এক বিকেলে সরেজমিন

গত ২৭ সেপ্টেম্বর বেলা তিনটার দিকে নগরের কালীবাড়ি থেকে হাওলদারপাড়া সড়কে সরেজমিনে দেখা গেছে, হাওলদারপাড়ামুখী সড়কের বাঁ দিকে নর্দমা প্রশস্তকরণের কাজ করছেন ১০ থেকে ১২ জন শ্রমিক। প্রায় আধা কিলোমিটারজুড়ে এ কাজ চলছে। জনস্বার্থে সবাই জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। এতে কারও বাসার প্রধান ফটক, নিরাপত্তাপ্রাচীর কিংবা বাসার অংশবিশেষসহ নানা স্থাপনাও ভাঙা পড়েছে।
কালীবাড়ি-হাওলদারপাড়া সড়কের সবুজবাগিচা ব্লক-বি-এর ৫ নম্বর বাসার অন্যতম স্বত্বাধিকারী সব্যসাচী দত্ত। তিনি সিলেট সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। সব্যসাচী জানান, মাসখানেক আগে নালা সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়। এ কারণে জনস্বার্থে তাঁরা ৩ ফুট জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। এর আনুমানিক মূল্য কয়েক লাখ টাকা। এরও আগে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য তাঁরা ১ ফুট জায়গা ছেড়েছিলেন।
রাস্তা ও নালা প্রশস্ত করতে সিটি করপোরেশনের এমন উদ্যোগের অনেকেই প্রশংসা করছেন নগরের অনেক বাসিন্দা। তবে স্বচ্ছল নয় এমন পরিবারও আছে, যারা জায়গা ছেড়েছে। তাঁদের জায়গার মূল্য যদি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ দিত, তাহলে ভালো হতো। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মালিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জায়গা ছেড়েছেন।    

ভবনের স্থাপনা ভেঙেও কেউ কেউ সড়কের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি সিলেট নগরের কালীবাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

করেরপাড়া এলাকার বাসিন্দা জ্যোৎস্না রানী দেব (৭০) নিজ বাড়ির ৩ ফুট জায়গা ছেড়েছেন। তিনি জানান, ৫ থেকে ৬ মাস আগে তাঁদের এলাকার সড়ক প্রশস্তকরণ করা হয়। সড়কের দুই পাশের বাসিন্দাদের সবাই ৩ ফুট করে জায়গা ছেড়েছেন। এতে সড়কটি আরও ৬ ফুট চওড়া হয়েছে। তিনি অন্যদের মতো জনস্বার্থে বিনা মূল্যে জায়গা দিয়েছেন।
আগের তুলনায় সিলেট শহরের রাস্তাঘাট অনেক প্রশস্ত হয়েছে। যানজটও কমেছে বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগরের অনেক বাসিন্দা সম্মিলিতভাবে জায়গা দান করার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। যাঁরা জায়গা ছেড়ে নগরবাসীর চলাচলের পথ সুগম করে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।’