গোদাগাড়ীতে পুকুর ইজারা নিতে সক্রিয় সিন্ডিকেট, শর্ত পূরণ না করেই মিলছে প্রত্যয়নপত্র

সাড়ে ছয় একরের বড় পুকুরটি গত মেয়াদে মাত্র ২ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সাগুয়ান মৌজায়ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় খাসপুকুর ইজারাপ্রক্রিয়ার শুরুতে আবারও একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিবছরই পুকুর ইজারার আগে এই সিন্ডিকেট হয়, যার বাইরে সাধারণ কোনো মানুষ দরপত্রপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্থানীয় একটি চক্র প্রতিবছর সিন্ডিকেট করে ‘পানির দরে’ খাসপুকুর ইজারা নিয়ে দ্বিতীয় দফায় সাধারণ মৎস্যচাষিদের কাছে চড়া দামে ইজারা দেয়। সমিতিতে প্রকৃত মৎস্যজীবী না থাকলেও তারা পুকুর ইজারা পায়। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এতে যোগসাজশ থাকে। ইতিমধ্যে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কাছ থেকে শর্ত পূরণ না করেই মৎস্যজীবী সমিতির প্রত্যয়নপত্র নেওয়ার জন্য সিন্ডিকেটের এক সদস্য মারমুখী আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ১৩ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে ‘গোদাগাড়ীতে খাসপুকুর ইজারায় “চুরি’’’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। তারা গত রোববার পর্যন্ত ২৯টি পুকুরের ইজারা বাতিল করেছেন।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৪৩২ থেকে ১৪৩৪ বঙ্গাব্দের জন্য ২ হাজার ২৩৬টি খাসপুকুর ইজারা দেওয়ার জন্য ২ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক আবুল হায়াত। মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) পর্যন্ত শিডিউল বিক্রি করার কথা আছে। অনেকেই ইতিমধ্যে শিডিউল কিনেছেন; কিন্তু তাঁরা অনলাইনে শিডিউল জমা দিচ্ছেন না।

আরও পড়ুন

খাসপুকুর ইজারা নিতে সক্রিয় সিন্ডিকেটে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এমন অন্তত ১২ জনের নাম স্থানীয় একটি সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে। যাঁরা শিডিউল কিনছেন, তাঁরা জমা না দিয়ে এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তাঁদের একজন মিনহাজ বাবু। সিন্ডিকেট তৈরির অভিযোগ পেয়ে সোমবার (২৭ জানুয়ারি) দুপুরে উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের সাইদুর রহমান পরিচয় দিয়ে তাঁকে ফোন করে বলা হয়, ‘ভাই আমার কাছে একটা সমিতির দুইটা শিডিউল আছে। আমি কি জমা দিব, ভাই?’ উত্তরে মিনহাজ বাবু বলেন, ‘ভাই তাড়াতাড়ি আসেন। জমা দেওয়ার দরকার নাই। আমরা সবাই মিলে এক জায়গায় করছি। কম রেট দিয়ে নিব। ওভার রেট দিয়ে লাভ কী। সবাই শিডিউল দিব। নিজ এলাকার পুকুর পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার থাকবে।’

সাইদুর পরিচয় দিয়ে মিনহাজ বাবুর সঙ্গে যোগাযোগের পর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘ভাই এটা সিন্ডিকেট না। সবাই অশিক্ষিত মৎস্যচাষি। ঠিকমতো শিডিউল জমা দিতে পারে না। বেশি দর দিয়ে লোকসান খায়। তাই সবাইকে একটু সহযোগিতা করছি।’

শর্ত না মেনেই প্রত্যয়নপত্র

সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি-২০০৯ অনুযায়ী, কেবল প্রকৃত মৎস্যজীবীরাই তাঁদের সমিতির মাধ্যমে  খাসপুকুর ইজারা নিতে পারবেন। মৎস্যজীবী সমিতিকে নিবন্ধিত হতে হয় সমবায় অধিদপ্তরে। আর এ জন্য প্রতিটি সমিতিতে কমপক্ষে ২০ জন সদস্য থাকতে হয়, যাঁদের মৎস্য বিভাগের দেওয়া এফআইডি (ফিশারিজ আইডি) থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ এই শর্ত লঙ্ঘন করেই নিবন্ধন দিয়েছে সমবায় বিভাগ।

ইজারাপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার আগে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কাছ থেকে একটি প্রত্যয়ন নিতে হয়। এই প্রত্যয়নে মৎস্য কর্মকর্তা লিখে দেন সমিতিতে কতজন এফআইডিধারী মৎস্যজীবী রয়েছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে, গোদাগাড়ীতে গড়ে ওঠা পুকুর সিন্ডিকেট প্রকৃত মৎস্যজীবীদের ছাড়াই সমবায় অফিস থেকে সমিতির নিবন্ধন নিয়েছে। এখন মৎস্য কর্মকর্তা প্রত্যয়ন দিতে গিয়ে দেখছেন, অনেক সমবায় সমিতিতেই শর্ত অনুযায়ী ২০ জন এফআইডিধারী মৎস্যজীবী নেই।

২০ জন এফআইডিধারী মৎস্যজীবী না থাকায় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. অহেদুজ্জামান মো. সুমন নামের সিন্ডিকেটের এক সদস্যকে  প্রত্যয়নপত্র দিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে সুমন গত রোববার তাঁর সঙ্গে মারমুখী আচরণ করেন। তাঁর বাড়ি গোদাগাড়ী পৌরসভার বারইপাড়ার গুড়িপাড়া মহল্লায়।

সুমনের মারমুখী আচরণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. অহেদুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউএনও মহোদয়ের হস্তক্ষেপে পরে এসে সে মাফ চেয়েছে। শর্ত পূরণ না করেই সে প্রত্যয়নপত্র দাবি করেছিল। তাকে দেওয়া হয়নি।’ এ পর্যন্ত প্রায় ২৫টি সমিতি প্রত্যয়ন নিয়েছে বলে তিনি জানান।

পরে অবশ্য গতকাল সোমবার মো. সুমনের ফরিদপুর মৎসজীবী সমবায় সমিতিকে একটি প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মৌখিক নির্দেশে এই সমিতিকে জলমহাল ইজারায় অংশগ্রহণের জন্য প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হলো।

পুকুর ইজারাপ্রক্রিয়ার শুরুতেই এবারও শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার ব্যাপারে জানতে চাইলে গোদাগাড়ীর ইউএনও এবং উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক আবুল হায়াত বলেন, ‘শিডিউল কিনে যে কোনো সমিতি ইজারাপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারবে। সিন্ডিকেটের বাইরে যদি এখন কেউ না আসে, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই।’ শর্ত পূরণ না করে প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর মৌখিক নির্দেশনার কথা বলে তিনটি প্রত্যয়নপত্র ইস্যু করা হয়েছিল। তিনি বিষয়টি জানতেন না। এর মধ্যে দুটি প্রত্যয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। অন্য একটিও বাতিল করা হবে।