খুলনায় ‘সভাপতিসর্বস্ব’ আওয়ামী লীগ, বিএনপিতে দ্বন্দ্ব

প্রায় দুই দশক ধরে তালুকদার আবদুল খালেক মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। নগর ও জেলা বিএনপিতে আছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন খুলনা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। মহানগরে প্রায় দুই দশক ধরে সভাপতির পদ আঁকড়ে থাকা তালুকদার আবদুল খালেকই শেষ কথা।

তাঁর নির্দেশনাতেই চলে সব। অপর দিকে তিন দশক ধরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ আগলে থাকা শেখ হারুনুর রশিদ আগের মতো দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এই সুযোগে জেলা কমিটির মধ্যে সমন্বয়ের বদলে দ্বন্দ্বই বেশি।

দ্বন্দ্ব, সংঘাত আছে খুলনা নগর বিএনপির নেতা–কর্মীদের মধ্যেও। দলটিতে নতুন–পুরোনো নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রকট। কয়েক ডজন মামলা মাথায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে আন্দোলন–সংগ্রামে আছেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তো আছেই।

মহানগরে ছন্দ নেই, জেলায় হযবরল

খুলনা মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা, সাংগঠনিক কার্যক্রম, আগামী নির্বাচন নিয়ে ভাবনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অন্তত ১০ জন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলছেন, দুই সংগঠনই আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তবে জেলা কমিটির মধ্যে সমন্বয় কম।

খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের ৫টি থানা ও ৩৬টি ওয়ার্ড ইউনিট রয়েছে। ইতিমধ্যে সদর থানা বাদে সব থানা ও ওয়ার্ডে নতুন করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বতন্ত্রভাবে থানা ও ওয়ার্ডে দলীয় কার্যক্রমও চলছে।

অন্যদিকে জেলায় রয়েছে ৯টি উপজেলা, ২টি পৌরসভা ও ৬৮টি ইউনিয়ন। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে শুধু দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে পেরেছে জেলা আওয়ামী লীগ। ওই দুটিরও এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। অন্যগুলোতে সম্মেলনের দিন ঘোষণা করেও তা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে আর কমিটি গঠন হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ।

জেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা বলছেন, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্ব, স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরোধিতা, বর্তমান নেতাদের আন্তরিকতার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে উপজেলা ও পৌরসভার কমিটি গঠন করা হচ্ছে না।

দলীয় সূত্র বলছে, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগে আপাতদৃষ্টে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সেখানে সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেকই শেষ কথা। তিনি যে নির্দেশনা দেন, বাকিরা তা–ই পালন করেন। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক সুজিত অধিকারীর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। তাঁদের ওই দ্বন্দ্বের কারণে নেতা–কার্মীরাও এখন দুই ভাগে বিভক্ত।

কথা বলার জন্য খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

তবে জেলার সাধারণ সম্পাদক সুজিত অধিকারী বলেন, সভাপতির অনেক বয়স হয়ে গেছে। এখন তিনি আগের মতো দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তারপরও সব কাজ একা করতে চান। এ কারণে মতপার্থক্য রয়েছে, তবে দ্বন্দ্ব নেই।

জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একটি দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করি। দলের মধ্যে গণতন্ত্র রয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। ওপর থেকে যে নির্দেশনা আসে, সে অনুযায়ী সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হয়। এখানে একক নির্দেশনার কোনো বিষয় নেই। আমি ন্যায়সংগত কথা বলি বলেই তা সবাই মেনে নেন।’

কোন্দলে বিভক্ত খুলনা বিএনপি

বছর কয়েক আগে খুলনা নগর বিএনপির বিরোধ এতটা প্রকাশ্য রূপ নিয়েছিল যে কেন্দ্রের বিভিন্ন কর্মসূচি দুটি পক্ষ পৃথকভাবে পালন করত। নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলামের সঙ্গে বর্তমান নেতৃত্বের পুরোনো সেই কোন্দল আবার ফিরেছে মাঠে। কিছুদিন ধরে আবারও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলছে।

সরকারবিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি জোরদারের এই সময়ে নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কর্মীদের মধ্যে যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তেমনি কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের করা মামলা, হয়রানি, গ্রেপ্তার–আতঙ্ক ও নতুন করে আসামি হওয়ার শঙ্কা ভর করছে কর্মীদের ওপর।

নগর বিএনপির সদস্যসচিব শফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মামলা ও পুলিশের হয়রানি সত্ত্বেও খুলনা বিএনপি এখনো অনেক শক্তিশালী। তাঁর নিজের নামেই ৯০টির বেশি মামলা আছে। অনেকের নামেই ২৫ থেকে ৬০টি পর্যন্ত মামলা আছে। নগর-জেলা মিলিয়ে কম করে হলেও ১০ হাজার নেতা–কর্মী মামলার আসামি বলে দাবি করেন এই নেতা। প্রতিদিন নেতা–কর্মীদের কোনো না কোনো মামলার হাজিরা থাকায় এক বেলা করে আদালতেই কাটছে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর একটা প্রভাব থাকে।

দলের একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির কেন্দ্রীয় ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারীর নেতৃত্বেই এখন খুলনা নগর ও জেলা বিএনপি চলছে। ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর হঠাৎ কেন্দ্র থেকে শফিকুল আলম ওরফে মনাকে আহ্বায়ক, তরিকুল ইসলামকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ও শফিকুল আলম ওরফে তুহিনকে সদস্যসচিব করে খুলনা মহানগর বিএনপির তিন সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।

ওই কমিটিতে ঠাঁই হয়নি দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে খুলনা নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্বে থাকা নজরুল ইসলামের। পরে তাঁকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর নজরুলের অনুসারী পাঁচ শতাধিক নেতা–কর্মী পদত্যাগ করেন। মাস তিনেক পর নগরে ৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে নজরুল অনুসারীদের কাউকেই রাখা হয়নি।

বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘খুলনায় বিএনপির জনপ্রিয়, ত্যাগী, পরীক্ষিত রাজপথের নেতা-কর্মীরা আমাদের সঙ্গেই আছে। আমরা আলাদা কর্মসূচি দিতে চাই না। তবে নেতা–কর্মীরা দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে চান। আমরা মনে করছি, কেন্দ্র খুলনার বিষয়টি শিগগির সুরাহা করবে।’

জানতে চাইলে সদস্যসচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘ভোটের মাধ্যমে ওয়ার্ড এবং পরে থানা আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। এখানে আমাদের পছন্দ-অপছন্দ এবং ব্যক্তিগত কোনো মতামত ছিল না। আমরা শুধু অনুমোদন দিয়েছি।’

এদিকে জেলা বিএনপির কয়েকজন নেতা জানালেন, তাঁদের ৮-১০ হাজার নেতা–কর্মীর নামে মামলা আছে। আবার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ক্রমেই বিভক্ত হয়ে পড়ছে জেলা বিএনপি। চলতি বছরের এপ্রিলে জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে পাঁচটি এবং দুটি পৌর পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির ঘোষণা দেন জেলার শীর্ষ দুই নেতা। এতে শুরু হয় ‘বিদ্রোহ’। কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে পাইকগাছা, চালনা পৌরসভা, ডুমুরিয়া, কয়রা ও বটিয়াঘাটার নেতারা সংবাদ সম্মেলন করেন।