চিংড়ির মালাইকারী রান্না করে পাক্কা রাঁধুনিতে সেরা সাইমা
আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল চুলা, হাঁড়িপাতিল। টেবিলে সাজানো নানা পদের সবজি, মসলা। ফ্রিজে রাখা রুই, রুপচাঁদা, চিংড়ি থেকে শুরু করে গরুর মাংস কিংবা আস্ত মুরগি। হুইসেল বাজতেই শুরু হয় রাঁধুনিদের দৌড়। কেউ ঝুড়িতে তুলে নেন শুঁটকি, কেউ মাংস, কেউ মাছ। এরপর চলতে থাকে ৫০ মিনিটে রান্নার ‘পরীক্ষা’।
আজ বুধবার বিকেলে কনফিডেন্স সল্ট-প্রথম আলো ‘পাক্কা রাঁধুনি’ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে এ চিত্র দেখা গেল। চট্টগ্রাম নগরের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে চিংড়ির মালাইকারি ও বাঁধাকপির পায়েস রান্না করে প্রথম পুরস্কার জিতে নেন রাঁধুনি সাইমা আক্তার। স্বাদে, ঘ্রাণে বিচারকদের মন জয় করায় সর্বোচ্চ নম্বর তুলে নেন তিনি।
বন্দরনগর চট্টগ্রামে তৃতীয়বারের মতো রান্নার এত বড় আয়োজন হলো। এতে অংশ নিতে ৫০০ রাঁধুনি আবেদন করেছিলেন। সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে ৮০ জনকে মনোনীত করা হয়। এরপর রেসিপি দেখে ৪০ জনকে দ্বিতীয় পর্বের জন্য নির্বাচিত করা হয়। সেখান থেকে ১০ জনকে চূড়ান্ত পর্বের জন্য বাছাই করেন বিচারকেরা। বিচারক ছিলেন র্যাডিসন ব্লু বে ভিউ চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ সু শেফ মো. খুরশেদ আলম, রন্ধনশিল্পী জেবুন্নেসা বেগম, ইসমত আরা আবেদিন, নাজনীন নাহার ইসলাম ও ফারহানা বীথি।
প্রতিযোগিতায় রাঁধুনিরা বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী সব পদ রান্না করেন। রুই মাছের কোরমা, চিংড়ির মালাইকারি, বগুড়ার আলুঘাঁটি, দোমাছা ভুনা, রুই রেজালা, পটোলের দোলমা, লইট্যা শুঁটকি ভুনা, চিংড়ি পোলাও—কী ছিল না চুলায়! বাহারি পদের এসব রান্নার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছিল মিলনায়তনজুড়ে। সেরা তিন রাঁধুনি বেছে নিতে বেগ পেতে হয় বিচারকদের।
চিংড়ি পোলাও রান্না করে দ্বিতীয় হন ফারমিন আজাদ। গরুর মাংসের রেজালা ও মুখরোচক সালাদ বানিয়ে বিচারকদের মন জয় করে নেন জিন্নাত আরা। তিনি অর্জন করেন তৃতীয় পুরস্কার।
রান্না ও বিচারকাজ শেষ হওয়ার পর শুরু হয় প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণার পর্ব। এ পর্বে গান ও কথামালায় মেতে ওঠেন অতিথি ও দর্শকেরা। মঞ্চে হাজির হয় সংগীত দল ‘সরলা’। তাদের গানের পর্ব শেষ হতেই শুরু হয় আলোচনা পর্ব।
সাড়াজাগানো আয়োজন
শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কনফিডেন্স সল্টের পৃষ্ঠপোষকতায় তৃতীয়বারের মতো এ বছর প্রতিযোগিতার আসর বসল। গত দুবারের তুলনায় এ বছরই সর্বোচ্চসংখ্যক প্রতিযোগী অংশ নিয়েছেন। প্রথম পর্বে ৫০০ জন আবেদন করেছিলেন। এতেই বোঝা যায়, বন্দরনগরে এ আয়োজন দারুণ সাড়া ফেলেছে। মূলত রন্ধনশিল্পীদের অনুপ্রেরণা জোগাতেই আমাদের এ আয়োজন।’
বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘অনেকেই প্রশ্ন করেন, সংবাদপত্রের সঙ্গে রন্ধনশিল্পের সম্পর্ক কী। আমরা বলি, প্রথম আলো সংবাদপত্রের চেয়ে একটু বেশি। এ কারণেই সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের “ইনমা গ্লোবাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০২৫”-এ প্রথম আলো পেয়েছে “দক্ষিণ এশিয়ার সেরা”র পুরস্কার। এটি গণমাধ্যমজগতে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। আমরা সব সময় পাঠককে প্রথম আলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছি। পাঠক দারুণভাবে সাড়া দিয়েছেন।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পোদ্যোক্তা ও লায়নস জেলা গভর্নর কোহিনূর কামাল কনফিডেন্স সল্ট ও প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, রান্নার এই প্রতিযোগিতা বন্দরনগরে সাড়া ফেলেছে। এত এত অংশগ্রহণকারীই এর প্রমাণ। সাধারণত এ ধরনের আয়োজন ঢাকায় বেশি হয়। কিন্তু আয়োজকেরা চট্টগ্রামই বেছে নিয়েছেন। এ প্রতিযোগিতা আরও বড় পরিসরে আয়োজন করতে হবে। সারা দেশের রন্ধনশিল্পীদের নিয়ে চট্টগ্রামে এ প্রতিযোগিতা হতে পারে। কেননা চট্টগ্রাম অনেক কিছুতেই পথ দেখিয়েছে।
অতিথির বক্তব্যে কনফিডেন্স সল্ট লিমিটেডের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) মোহাম্মদ তৈয়ব বলেন, ‘প্রতিভাবান রন্ধনশিল্পীদের খুঁজে বের করতে প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ আয়োজন করছে কনফিডেন্স সল্ট। গত দুবার সফলতার সঙ্গে আমরা আয়োজন করেছি।’
চট্টগ্রামে আবার এ ধরনের রান্নার প্রতিযোগিতা হবে বলে দর্শকদের আশ্বাস দেন কনফিডেন্স সল্ট লিমিটেডের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা (সিএমও) সরদার নওশাদ ইমতিয়াজ। তিনি প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘ভোজনরসিক ও রন্ধনশিল্পীদের জন্য আজ আনন্দের একটা দিন। এর শুরুটা হয়েছিল ২০২৩ সালে। পাঠকেরা প্রথম আলোকে যেভাবে সাদরে গ্রহণ করেছেন, ঠিক তেমনি ভোক্তারা কনফিডেন্স সল্টকে গ্রহণ করেছেন। খুব শিগগির আমরা বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় লবণ কারখানা উদ্বোধন করব।’
সরদার নওশাদ ইমতিয়াজ বলেন, দেশীয় ঐতিহ্যবাহী নানা পদের রান্না হলো এ আয়োজনে। শুরুতে শুধু চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পদগুলো রান্না হতো। এরপর রাঁধুনিদের আগ্রহে সেটি উন্মুক্ত করা হয়। এরপরই মূলত দেশের বিভিন্ন এলাকার ঐতিহ্যবাহী পদগুলো নিয়ে হাজির হন রাঁধুনিরা।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আবৃত্তিশিল্পী সেলিম রেজা ও শারমিন মুস্তারি। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল প্রথম আলো বন্ধুসভা।
অনুপ্রেরণা জোগাবে
প্রথম পুরস্কার পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন সাইমা আক্তার। তিনি স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। শখের বসে রান্না করেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই রান্নার প্রতি ঝোঁক ছিল। অবসর পেলেই নতুন ধাঁচের পদ রান্না করি। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম পুরস্কার পাব, তা ভাবিনি। এই স্বীকৃতি আমাদের অবশ্যই অনুপ্রেরণা জোগাবে।’
দ্বিতীয় পুরস্কার পাওয়া ফারমিন আজাদ পুরস্কার নিয়ে বলেন, গত বছরও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সেরা দশেও ছিলেন। কিন্তু পুরস্কার না পাওয়ায় কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল তাঁর। আজ পুরস্কার পেয়ে দারুণ খুশি তিনি।
তৃতীয় পুরস্কার পাওয়া জিন্নাত আরা বলেন, ‘মাত্র ৫০ মিনিটের মধ্যে রান্নার এ পরীক্ষা সত্যিই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। শুরুতেই রান্নার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আমার এই পদ যে বিচারকেরা পছন্দ করেছেন, তাতে আমি আনন্দিত।’
প্রতিযোগীদের রান্না বিচার করতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিচারক নাজনীন নাহার ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিটি পদ ছিল সুস্বাদু। প্রতিযোগিতা বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পরম যত্নে রেঁধেছেন। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে প্রতিযোগীদের কাজে লাগবে।