নৌ পুলিশ ফাঁড়ির পাশেই প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে মহাবিপন্ন বাগাড়, আইনের প্রয়োগ নেই

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার পদ্মা নদীর বাহিরচর কলা বাগান এলাকায় এক জেলের জালে প্রায় ৫০ কেজি ওজনের বিশাল এই বাগাড় মাছটি ধরা পড়ে। গত শনিবার বিকেলে
ছবি: প্রথম আলো

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির মাত্র ২০ গজ দূরেই মাছ বাজার। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত বসে বাজারটি। এখানে পদ্মা নদীর বিভিন্ন তরতাজা মাছ পাইকারি বিক্রি হয়ে থাকে। সেখানেই অন্য মাছের সঙ্গে প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি হচ্ছে মহাবিপন্ন বাগাড় মাছ।

যদিও আইন অনুযায়ী এই মাছ শিকার, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধ। কিন্তু আইনের প্রয়োগ না থাকায় প্রতিদিন অবাধে এই মাছ ধরা ও বিক্রি থামছে না।

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের তালিকা অনুযায়ী, বাগাড় একটি মহাবিপন্ন প্রাণী। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী বাগাড় শিকার, বিক্রি ও পরিবহন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। আইন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়ন না থাকায় বাগাড় শিকার ও প্রকাশ্যে নিলামে বিক্রি অব্যাহত আছে। দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় প্রতিদিন একাধিক বাগাড় বিক্রি হলেও এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

আজ রোববার ভোর ছয়টায় ঘুম চোখে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক দিয়ে ভ্যানে ছুটছিলেন ছয় ব্যক্তি। পাশে প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রাখা একটি বাগাড় মাছ। বিক্রির জন্য নিচ্ছেন দৌলতদিয়া বাজারে। মাছটি রাজীব সরদার নামের এক ব্যক্তির। রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট অন্তারমোড় বাড়ি। গতকাল শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে অন্তারমোড় বাঁধের মাথায় পদ্মা নদীতে ফাঁসওয়ালা সুতি জালে বাগাড়টি ধরা পড়ে।
মহাবিপন্ন বাগাড় মাছ শিকার ও বিক্রি নিষিদ্ধ জানেন কি না, জানতে চাইলে রাজীব সরদার বলেন, ‘এটা আমরা জানি। জালে পড়লে করব কী। এ ধরনের জালে পাঙাশ, রুইসহ বড় মাছ আটকা পড়ে। এখন জালে বাগাড় আটকা পড়েছে, বিক্রির জন্য নিয়া আইছি।’

আরও পড়ুন

বাজারের একতা মৎস্য আড়তে নিয়ে বাগাড় মাছটি রাখেন রাজীব সরদার। নিলামে তোলা হলে বাগাড়টি ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। প্রায় ৮ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের বাগাড়টি ফেরিঘাট এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী মোমিন মোল্লা কেনেন।

কিছুক্ষণ পর আরেকটি বাগাড় নিয়ে আসেন আরেক জেলে। আনু খার আড়তে নিলামে তোলা হলে এ বাগাড়টিও ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। ৮ কেজি ৬০০ গ্রাম ওজনের বাগাড়টি কেনেন ফেরিঘাট এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী মাসুদ মোল্লা। মহাবিপন্ন প্রাণী জানা সত্ত্বেও মাছটি কিনছেন কেন? জবাবে মাসুদ মোল্লা বলেন, ‘জেলেরা ধরে এখানে নিয়ে আসে, খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। তাই আমরাও তাঁদের থেকে কিনে নিচ্ছি। প্রতিদিন দুই-তিনটি করে বিক্রি হচ্ছে। গত কয়েক দিনে ১২-১৩টি বাগাড় বিক্রি হয়েছে।’

আজ দুপুরে রওশন মোল্লার আড়তে প্রায় ১৬ কেজি ওজনের আরেকটি বাগাড় বিক্রি হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী চান্দু মোল্লা ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে এটি কিনে নেন। বাগাড়টি স্থানীয় জেলে আনিস হালদারের জালে ধরা পড়ে। গতকাল চান্দু মোল্লা প্রায় ৫০ কেজি ওজনের আরেকটি বাগাড় ৭৭ হাজার ৫০০ টাকায় কিনে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। চান্দু মোল্লা বলেন, এই মৌসুমে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি বাগাড় ধরা পড়েছে।

একতা মৎস্য আড়তদার রেজাউল মন্ডল বলেন, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও পাবনার জেলেরা প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি বড় নৌকায় মাছ শিকার করেন। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত এই বাজারে পদ্মার তরতাজা পাঙাশ, রুই, কাতলা, রিঠা, ইলিশ ও বাগাড় বিক্রি হয়। পদ্মা নদীর মাছ অনেক সুস্বাদু বলে দূরদূরান্ত থেকে অনেকে আসেন। এখন বর্ষা মৌসুম, মাছের আমদানি হচ্ছে বেশি। বাগাড় মাছ সম্পর্কে রেজাউল বলেন, আগের থেকে বাগাড় এখন বেশি ধরা পড়ছে। বাগাড় নিষিদ্ধ মহাবিপন্ন প্রাণী সম্পর্কে মৎস্য বিভাগ অনেক আগে এখানে এক সভায় অবগত করেছিল। পদ্মার থেকে যমুনা নদীতে বাগাড় বেশি ধরা পড়ছে বলে জানান তিনি।

চোখের সামনে প্রকাশ্যে বাগাড় বিক্রির বিষয়ে নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ত্রিনাথ সাহা বলেন, বিষয়টি নিয়ে ওইভাবে ভাবা হয়নি। তবে এখন থেকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে নৌ পুলিশের গাফিলতি নেই বলেও তিনি দাবি করেন।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা জানান, মৎস্য আইনে ৩৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত আইড়, সিলন, বোয়াল শিকার নিষিদ্ধ থাকলেও বাগাড় নিষিদ্ধের বিষয়ে বলা নেই। তিনি বলেন, ‘বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে বাগাড় শিকার বা বিক্রি নিষিদ্ধ। জেলেদের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে পারি। আগামীতে বিভাগীয় সভায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরব। আমাদের করার কিছু না থাকলেও প্রশাসনিক পর্যায়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।’

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাহিদুর রহমান বলেন, ‘বন্য প্রাণী ও সংরক্ষণ অধিদপ্তর আমাদের কাছে প্রসিকিউশন দিলে ব্যবস্থা নিতে পারি। খবর পাওয়ার পর অভিযানের আগেই জড়িত ব্যক্তিরা অন্যত্র চলে যাওয়ায় আটক করতে পারি না। মৎস্য অধিদপ্তর জেলেদের নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক সভা করতে পারে। যেসব মাছ ধরা নিষেধ, এসব থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই।’