খালিই পড়ে থাকে বাসা, তবু হচ্ছে নতুন ভবন

কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ১০ ও ১১ তলাবিশিষ্ট আরও ছয়টি আবাসিক বাসভবন, কমপ্লেক্স ও আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে।

  • থাকার মতো আগ্রহী কাউকে না পাওয়ায় ১৯০টি বাসাই খালি পড়ে আছে।

  • শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য নতুন ভবন বানাতে ব্যয় হচ্ছে ১২০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত আবাসিক ভবন খালি পড়ে আছে। সম্প্রতি শহীদ সালাম বরকত হল ও আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের পাশে
ছবি: প্রথম আলো

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বসবাসের জন্য ৪৭৮টি বাসা আছে। থাকার মতো আগ্রহী কাউকে না পাওয়ায় ১৯০টি বাসাই খালি পড়ে আছে। ১৬টি হলের প্রাধ্যক্ষের জন্য সাতটি একক দোতলা (ডুপ্লেক্স) বাসা আছে।

বাকি ৯ প্রাধ্যক্ষ ‘এ’ টাইপের বাসা বরাদ্দ পান। কিন্তু তিনটি একক দোতলা ও ছয়টি ‘এ’ টাইপের বাসা খালি পড়ে আছে। ক্যাম্পাসের বাসা ব্যবহার করেন না ১১ জন প্রাধ্যক্ষ। না থাকার তালিকায় আছেন কোষাধ্যক্ষও।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ১০ ও ১১ তলাবিশিষ্ট আরও ছয়টি আবাসিক বাসভবন, কমপ্লেক্স ও আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে। ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় এই খাতে ব্যয় হচ্ছে ১২০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। উন্নয়ন প্রকল্পে সরকার মোট বরাদ্দ দিয়েছে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

পর্যাপ্ত বিচার–বিশ্লেষণ ছাড়াই এসব ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা অঞ্চল বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিকল্পনা করার অন্যতম শর্ত হলো উন্নয়নের চাহিদা বিশ্লেষণ করা।

প্রকল্পের সুবিধাভোগী যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তে যাওয়া। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যেসব ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোর চাহিদা কতটুকু, কোথায় নির্মাণ করলে ভালো হবে—সেসব বিষয়ে কোনো আলোচনা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া ভবন নির্মাণের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারানোর পাশাপাশি ইট-কংক্রিটের নগরে পরিণত হবে বলে অভিযোগ করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আমরা এগুলো সংশোধনের জন্য বারবার কথা বলেছি কিন্তু দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। ফলে জাহাঙ্গীরনগর যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, অপরিকল্পনার কারণে সেটি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে।’

আবাসিক হলগুলোর প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে অবস্থান করার কথা। অন্যদের বিষয়ে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
রহিমা কানিজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক রেজিস্ট্রার

প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করেই নতুন বাসভবনগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নূরুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবাসিক ভবনগুলো পুরোনো হওয়ায় অনেকেই হয়তো এখন থাকতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে নতুন ভবন হওয়ার পর এ চিত্র পাল্টে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।’ ভবিষ্যতে যাঁরা ক্যাম্পাসে সার্বক্ষণিকভাবে থাকবেন, কেবল তাঁদেরই হল প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলেছেন, কোয়ার্টারে থাকতে গেলে অধিক ভাড়া দিতে হয়। নিজস্ব ভবন এবং ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে স্বচ্ছন্দে থাকার কারণে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ক্যাম্পাসের বাসাগুলোতে থাকতে আগ্রহী হন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক বাড়ি বানিয়ে থাকছেন সাভারের অরুণাপল্লিতে। ওই এলাকায় নিজস্ব বাসা ও ফ্ল্যাটে শতাধিক শিক্ষকের বসবাস। তাঁদের পরিবহনের জন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন আমবাগান, ইসলামনগরসহ সাভারের বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব বাসা ও ফ্ল্যাটে থাকছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একটি বড় অংশ। অনেকেই আবার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় নিজ বাড়ি থেকে যাতায়াত করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ক্যাম্পাসে থাকার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা তৈরি না করে। তবে যাঁরা এখন ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন, তাঁদের প্রায় সবাই ক্যাম্পাসে থাকতে অনীহা প্রকাশ করবেন।
রায়হান রাইন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্চের সমন্বয়ক

বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিভাগের তথ্যমতে, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের পদভেদে মূল বেতনের ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ বেশি বাসাভাড়া বাবদ ভাতা দেওয়া হয়। কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই ভাতা হয় মূল বেতনের ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত। যাঁরা ক্যাম্পাসের বাসায় থাকেন, তাঁরা ভাতা পান না। যাঁরা বাইরে থাকেন, তাঁরা ভাতার টাকা পান।

ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের জন্য ‘এ, বি, সি এবং ডি টাইপ’ মিলিয়ে ২৬৪টি বাসা আছে। এর মধ্যে ৮৩টি বাসা এখনো খালি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ই ও এফ টাইপের ২১৪টি বাসা আছে। এর মধ্যে ১০৭টিই খালি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক হলগুলোর প্রাধ্যক্ষ ও আবাসিক শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে অবস্থান করার কথা। অন্যদের বিষয়ে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাউস টিউটরদের জন্য প্রায় ১৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০ তলা বাসভবন, প্রাধ্যক্ষদের জন্য ১৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বাসভবন, প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষকদের জন্য ১১ তলা আবাসিক টাওয়ার, সাড়ে ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্মকর্তাদের আবাসিক টাওয়ার, ১৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য আবাসিক টাওয়ার ও ১১ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্মচারীদের আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ করা হচ্ছে।

শিক্ষকেরা বলছেন, আবাসিক ভবন নির্মাণের আগে ক্যাম্পাসের বাসভবনে কতজন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী থাকতে আগ্রহী সেটির একটি তালিকা তৈরি করা, অপেক্ষাকৃত পুরোনো ভবনগুলোকে ভেঙে সেই স্থানগুলোকে ভবন নির্মাণের জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া এবং আগামী দিনে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা কত হতে পারে, সে বিষয়টিকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা উচিত ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্চের সমন্বয়ক রায়হান রাইন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ক্যাম্পাসে থাকার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা তৈরি না করে। তবে যাঁরা এখন ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন, তাঁদের প্রায় সবাই ক্যাম্পাসে থাকতে অনীহা প্রকাশ করবেন।

আর বাস্তবতার নিরিখে বাধ্যবাধকতার বিষয়টি প্রায় অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস আছে। যাতায়াতব্যবস্থা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। নিজেদের বাড়ি এবং ফ্ল্যাট থাকলে কেন কেউ বাড়িভাড়ার ভাতা দিয়ে ক্যাম্পাসের বাসায় থাকতে চাইবেন?