নিজের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করে পড়ালেখা করছে জেসমিন, এবার সে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম
জেসমিন খাতুনের বয়স তখন ১৩ বছর। পড়ত অষ্টম শ্রেণিতে। রাজশাহীর আলোর পাঠশালার এই ছাত্রীর গত বছর বিয়ের আয়োজন করেছিল তার পরিবার। পরে পাঠশালার শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে জেসমিন নিজের বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। সেই সঙ্গে পড়াশোনায় হয়েছে আরও বেশি মনোযোগী। অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় এবার সে ২৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম হয়েছে।
এমন ফলাফলের মধ্য দিয়ে জেসমিন তার পরিবারের ভুল ভাঙাতে পেরেছে। পরীক্ষার ফল হাতে পেয়েই তার মা এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছেন। অথচ গত বছর জেসমিন খাতুনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর আয়োজন চলছিল। কৌশলে শিক্ষকদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আসার কথা বলে সে আলোর পাঠশালা এসে শিক্ষকদের বিয়ের বিষয়টি জানিয়ে দেয়। দ্রুত শিক্ষকেরা জেসমিনের বাড়িতে যান। বিষয়টি সমাজসেবা অধিদপ্তরকেও জানানো হয়। পরে সমাজসেবার লোকজনও চলে আসেন জেসমিনদের বাড়িতে। সবার উপস্থিতি দেখে জেসমিনের পরিবার বরযাত্রীদের পাশের বাড়িতে লুকিয়ে রাখে। পাশের বাড়িতে শিক্ষকদের বসতে দেওয়ার জন্য চেয়ার আনতে গিয়ে সেটিও দেখে ফেলে জেসমিন। সে গোপনে শিক্ষকদের সব জানিয়ে দেয়। শিক্ষকেরা এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরে কর্মকর্তারা জেসমিনের মাকে বোঝান এবং মেয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়ে বিয়েটি ভেঙে দেওয়া হয়।
এসব বাধা কিছুই জেসমিনকে তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমাতে পারেনি, বরং তার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ আরও বেড়েছে। সে তার শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে পড়াশোনার প্রতি বেশি মনোযোগী হয়েছে। এবার সে অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।
তার বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা জানান, লেখাপড়ার পাশাপাশি মেয়েটির কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, গান, নাচ ও বিতর্কচর্চার মতো সহপাঠক্রমেও অনেক আগ্রহ লক্ষ করা যায়। স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সে জয়লাভ করেছে। তার ক্লাসে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সবাইকে সে পড়াশোনায় এবং বিভিন্ন সমস্যায় সাহায্য করে।
জেসমিনের বাবা নেই। মা তার একমাত্র অভিভাবক। নানা রকমের পারিবারিক বাধা ও আর্থিক অসচ্ছলতা—এসবের কিছুই তাকে মানসিকভাবে দমাতে পারেনি। অদম্য জেসমিনের বড় হয়ে একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা। শিক্ষকতা পেশায় কেন যেতে চায়, জানতে চাইলে জেসমিন বলে, শিক্ষকদের সে অনেক সম্মান করে। সে বড় হয়ে তার মতোই সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে চায়। যেন কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের শুরুতে বা মাঝপথে পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়তে না হয়।
মেয়ের বাল্যবিবাহের আয়োজনের বিষয়ে মা কনা খাতুন বলেন, ‘ওইটা ছিল আমার জীবনে বড় একটা ভুল। বলতে পারেন একটা অ্যাক্সিডেন্ট। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমার মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছে। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি এই অভাবের সংসারে ৫০০ টাকার মিষ্টি কিনে এনে এলাকাবাসীকে খাইয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মেয়ের মা, আর আপনারা মানে আলোর পাঠশালার শিক্ষকেরা হচ্ছেন তার দ্বিতীয় মা–বাবা। আপনারা আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন। আর আমার পরিবারের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন, এটাই আপনাদের কাছ থেকে আমার চাওয়া।’
রাজশাহী আলোর পাঠশালার প্রধান শিক্ষক রেজিনা খাতুন বলেন, পড়াশোনার ব্যাপারে জেসমিন খাতুনের যে আগ্রহ, তাতে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। তাঁরা ওর সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন।