দাম বাড়ায় মিয়ানমারের ছোলা আমদানি করা হচ্ছে না

কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমার থেকে আনা ছোলা ভর্তি বস্তা
ছবি: প্রথম আলো

আর মাত্র একটা দিন পর শুরু হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। রোজার মাস এলে কক্সবাজার অঞ্চলের সাধারণ মানুষের দৃষ্টি থাকে মিয়ানমারের ছোলার দিকে। মিয়ানমারের ছোলা দামে সস্তা ও গুণমানে ভালো। কিন্তু এবার রোজার মাসে মিয়ানমারের ছোলা আমদানি হচ্ছে না।

ব্যবসায়ীদের দাবি, মিয়ানমারে ছোলার দাম অনেক বেড়েছে। টেকনাফের কয়েকজন ব্যবসায়ী মিয়ানমারের আকিয়াব শহরে কয়েক শ মেট্রিক টন ছোলা কিনে ফেলে রেখেছেন। লোকসানের শঙ্কায় ছোলাগুলো টেকনাফ স্থলবন্দরে আনা যাচ্ছে না। স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তারাও বলছেন, গত রমজান মাসজুড়ে মিয়ানমার থেকে এক হাজার মেট্রিক টনের বেশি ছোলা, পেঁয়াজ, আদা-রসুন আমদানি হলেও এবার আদা–রসুন ছাড়া ছোলা ও পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভাটা পড়তে পারে।

আজ বুধবার স্থলবন্দর ঘুরে দেখা গেছে, বৈরী পরিবেশেও মিয়ানমার থেকে কাঠ, হিমায়িত মাছ, আদা-রসুন, আচার, মরিচবোঝাই কয়েকটি জাহাজ এলেও এক কেজি ছোলা আসেনি।

মিয়ানমারের ব্যবসায়ী ক্য মং (৫৬) প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দেশের সিথুয়ে, মান্দালয় বন্দরে বিপুল ছোলা মজুত আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ছোলা কিনছেন না। তবে এটা ঠিক, গত কয়েক মাসে ছোলার দাম কেজিতে ২০-২৫ টাকা বেড়েছে, এটাও ডলার–সংকটের কারণে।

টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (হিসাব) মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, টানা কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণে ছোলা আমদানি হয়ে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ ছোলা আমদানি বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি মিয়ানমার থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আনা ছোলাবোঝাই একটি ট্রলার পুনরায় মিয়ানমারে ফিরে গেছে। কারণ, মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশের বাজারে ছোলার দাম কম। এতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা লোকসানের আতঙ্কে ছোলা আমদানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই স্থলবন্দরে সর্বশেষ ৭ মার্চ একটি কার্গো ট্রলারে ৭১৫ বস্তা (প্রায় ৩৪ মণ) ছোলা আমদানি করে মেসার্স ফারুক ট্রেডার্স নামে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক বলেন, পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে তিনি মিয়ানমারের সিথুয়ে বন্দর থেকে ছোলা কিনে টেকনাফ স্থলবন্দরে নিয়ে এসেছিলেন। তখন মিয়ানমারে ছোলার দাম পড়েছিল প্রতি কেজি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। সেই ছোলা জাহাজে বা কার্গো ট্রলার বোঝাই করে ৩৬০ কিলোমিটার দূরত্বে বঙ্গোপসাগর-নাফ নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফ বন্দরে পৌঁছানো, খালাস এবং পরিবহনের ক্ষেত্রে শ্রমিকের খরচ যায় আরও ছয় থেকে আট টাকা। সে ক্ষেত্রে টেকনাফ বন্দরে পৌঁছাতে মিয়ানমারের ছোলার প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৯৬ থেকে ১০৩ টাকা। অথচ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে অস্ট্রেলিয়ার ছোলা বেচাবিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৩ টাকায়। লোকসান দিয়ে আমদানির ছোলা বিক্রি করতে হয় জানিয়ে ওমর ফারুক বলেন, এখন মিয়ানমারে বাংলাদেশি কয়েকজন ব্যবসায়ীর কয়েক শ মণ ছোলা ক্রয় করা আছে, কিন্তু লোকসানের ভয়ে ছোলাগুলো টেকনাফ আনা যাচ্ছে না।

বন্দরের শুল্ক বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২২ সালে টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমারের ছোলা আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ১৮৭ দশমিক ২৬০ মেট্রিক টন। ২০২১ সালে হয়েছিল ১ হাজার ৪৯১ মেট্রিক টন। এর অর্ধেক ছোলা আমদানি হয়েছিল রোজার মাসে।

বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে মিয়ানমারের ছোলার চাহিদা বেশি জানিয়ে টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর এহতেশামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ডলার–সংকটে মিয়ানমারের ছোলার দাম বেড়েছে। আগে মিয়ানমারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ছিল ৫০-৫২ টাকা। সেই ছোলা টেকনাফের বাজারে ৬৫ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হতো। এখন মিয়ানমারে ৯০-৯৫ টাকায় ছোলা কিনতে হচ্ছে। অথচ এরও কম দামে দেশের বাজারে ছোলা পাওয়া যাচ্ছে। লোকসানের আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা ছোলা আমদানিতে ঝুঁকি নিচ্ছেন না।

রোজার মাসে টেকনাফের ব্যবসায়ীদের চড়া মূল্যে বিক্রির জন্য মিয়ানমারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বিপুল পরিমাণ ছোলা মজুত করে রাখেন জানিয়ে টেকনাফ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল আমিন জানান, বাংলাদেশে ছোলার দাম কম বলে ব্যবসায়ীরা ওই ছোলা কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বাংলাদেশে ছোলার দাম আরও বাড়লে তখন মিয়ানমারের ছোলা আনা যাবে।

টেকনাফ পৌরসভার বাসস্টেশন, লামাবাজার, উপরের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন দোকানে মিয়ানমারের ছোলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১১০ টাকায়, অস্ট্রেলিয়ান ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।

টেকনাফ বাসস্টেশনের ছোলা ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার ও মোহাম্মদ কাশেম জানান, দাম বেশি হলেও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে মিয়ানমারের ছোলার কদর বা চাহিদা রয়েছে। বন্দরে ছোলা আমদানি বন্ধ থাকায় টেকনাফের ব্যবসায়ীদের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে ছোলা কিনে আনতে হচ্ছে।

কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বর্তমানে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বসতি রয়েছে। রোহিঙ্গারা রমজান মাসজুড়ে মিয়ানমারের ছোলা দিয়ে ইফতার করেন। টেকনাফ বন্দর দিয়ে ছোলা আমদানি বন্ধ থাকলে ছোলার সংকট দেখা দিতে পারে। দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।

টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা এ কে এম মোশাররফ হোসেন জানান, পবিত্র রমজান উপলক্ষে মিয়ানমার থেকে ছোলা আমদানি করতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। ছোলা আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায়ও হচ্ছে না। তারপরও লোকসানের আতঙ্কে ছোলা আমদানি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।