২৮ বছর ধরে হলুদ-মরিচের গুঁড়া বিক্রি করে সংসার চালান মালেক
আবদুল মালেক ১৬ বছর বয়স থেকে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর মিলে হলুদ ও মরিচ ভাঙানোর কাজ করতেন। এ কাজ করে যা আয় হতো, তা তুলে দিতেন বাবার হাতে। হঠাৎ একদিন হলুদ-মরিচ ভাঙানোর মেশিনের ফিতার সঙ্গে জড়িয়ে ডান হাত হারান তিনি। সেই থেকে মালেক শারীরিক প্রতিবন্ধী। তবে তিনি থেমে যাননি। ২৮ বছর ধরে হলুদ ও মরিচের গুঁড়া বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ পৌরসভার কসবা গ্রামের বাসিন্দা ৪৬ বছর বয়সী আবদুল মালেক। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও অন্যের কাছে হাত না পেতে নিজের উপার্জনে চালান সংসার।
নিজের ডান হাত হারানোর গল্প বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আবদুল মালেক। তিনি বলেন, অভাবের সংসারে লেখাপড়া না করে ভবানীগঞ্জ বাজারের তৈয়বুর রহমানের মরিচ, হলুদ ও ময়দা ভাঙানোর মিলে শ্রমিকের কাজ নেন। তাঁর উপার্জনের টাকায় বাবার সংসার চালানোর সহায়ক হয়। ১৯৯৬ সালে হলুদের গুঁড়া তৈরি করার সময়ে মেশিনের ফিতার সঙ্গে অসাবধানতাবশত ডান হাত জড়িয়ে পড়ে। এতে তাঁর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পুরো ডান হাত। দ্রুত তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে টানা ২৩ দিন চিকিৎসা শেষে বাড়িতে ফেরেন। সেই থেকে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী।
এক হাত হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন আবদুল মালেক। হয়তো অন্যের কাছে হাত পাততে অথবা পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে হবে—এমনটা ভেবেছিলেন। তবে নিজ প্রচেষ্টায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন। এক হাত নিয়ে আবার সেই মিলে কাজে যোগ দিলেন। কিছুদিন পরে অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। তবে আগের মতো আর কাজ করতে পারেন না। এক হাত দিয়ে বস্তা টানাটানি ও ওঠানামা করাতে পারেন না। মিলমালিকের চাহিদাও মেটাতে পারেন না। এতে নিজেকে অপরাধী মনে হয় মালেকের। একপর্যায়ে মিলের অপারেটরের কাছ ছেড়ে দেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাজার থেকে মরিচ ও হলুদ কিনে গুঁড়া করে তা বিক্রির কাজ শুরু করলেন। ১৯৯৬ সালে সেই যে শুরু করলেন ব্যবসা, তা আজও চালিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি আবদুল মালেককে উপজেলা পরিষদের প্রধান ফটকের পাশে একটি দোকানের সামনে ফুটপাতে হলুদ ও মরিচের গুঁড়া বিক্রি করতে দেখা গেল। ক্রেতারা আসলে তাঁদের চাহিদামতো গুঁড়া সরবরাহ করেন। কেনাবেচায় বাঁ হাত ও মুখ ব্যবহার করেন। ওজন পরিমাপের জন্য ব্যবহার করেন ডিজিটাল মিটার। পলিথিনে গুঁড়া ভরার পর মুখ দিয়ে প্যাঁচ দিয়ে আটকিয়ে ক্রেতার হাতে তুলে দেন। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে থাকেন গুঁড়ার পসরা নিয়ে। সেখানে আলাপকালে আবদুল মালেক বলেন, বিভিন্ন হাট থেকে কাঁচামরিচ কিনে রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করেন। আবার কাঁচা হলুদ কিনে কেটে গরম পানিতে ডুবিয়ে সেদ্ধ করার পর রোদে শুকিয়ে মিলে নিয়ে এসে গুঁড়া করে তা বিক্রি করে থাকেন।
অনেক সময় রাজশাহীর সাহেববাজার থেকে শুকনা হলুদ কিনে বাড়িতে নিয়ে এসে মেশিনে গুঁড়া করে থাকেন। তাঁর এসব কাজে স্ত্রী সহযোগিতা করেন। এই কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই চালান সংসার। ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। বড় ছেলে এবার ভবানীগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছোট মেয়ে একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। আবদুল মালেক বলেন, তাঁর পুঁজি কম। এ কারণে চাহিদামতো হলুদ–মরিচের গুঁড়া সরবরাহ করতে পারেন না। ছেলে কলেজে ভর্তি হলে খরচ বাড়বে, এ নিয়ে চিন্তিত।
একই গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান বলেন, ছোটকাল থেকে প্রতিবন্ধী আবদুল মালেককে ভবানীগঞ্জে ফুটপাতে বসে হলুদ মরিচের গুঁড়া বিক্রি করতে দেখছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
মালেকের স্ত্রী ববিতা খাতুন বলেন, তাঁর স্বামী প্রতিবন্ধী হলেও অন্যের কাছে হাত পাতেন না। নিজের আয়ে সংসার চালান। তিনি স্বামীর এই কাজে সহযোগিতা করে থাকেন। এক হাত না থাকার কারণে বিকল্প হিসেবে মুখ ব্যবহার করেন।