দুই যমজ বোনের ভরসা এখন অসহায় দাদি

অতিদরিদ্র ফিরুজা চরজঙ্গলদী গ্রামে স্বামীর রেখে যাওয়া ৩ শতাংশ জমিতে একটি জরাজীর্ণ ঘরে দুই নাতনিকে নিয়ে বসবাস করছেন।

গত সোমবার সদর উপজেলার বলাইয়েরচর ইউনিয়নের চরজঙ্গলদী গ্রামে
প্রথম আলো

জেসমিন-ইয়াসমিন যমজ বোন। তাদের বয়স এখন মাত্র দুই বছর। জন্মের কয়েক মাস পর থেকেই মা–বাবার সন্ধান নেই। বাবা ছামেদুল হক দুই সন্তানকে রেখে যান ৬৭ বছর বয়সী দাদি ফিরুজা বেগমের কাছে। সেই দাদিই এখন অভাবের সঙ্গে লড়াই করে যমজ দুই বোনকে লালন-পালন করছেন। কিন্তু এই দুই অনাথ শিশুর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি সহায়তা। নইলে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, যমজ বোন জেসমিন ও ইয়াসমিন শেরপুর সদর উপজেলার বলাইয়েরচর ইউনিয়নের চরজঙ্গলদী গ্রামের ছামেদুল হকের মেয়ে। তাদের মার নাম রোকিয়া বেগম। ছামেদুল ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করতেন। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানেই থাকতেন। শিশু দুটির জন্মও হয়েছিল ঢাকাতেই। কিন্তু শিশু দুটির জন্মের মাত্র আড়াই মাসের মাথায় তাদের মা রোকিয়া মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এরপর তাদের বাবা ছামেদুল দুই শিশুকন্যাকে ফিরুজা বেগমের কাছে রেখে যান। এরপর থেকে জেসমিন-ইয়াসমিনের মা–বাবার কোনো সন্ধান নেই।

প্রায় চার বছর আগে ফিরুজার স্বামী মইনা মিস্ত্রি মারা যান। অতিদরিদ্র ফিরুজা চরজঙ্গলদী গ্রামে স্বামীর রেখে যাওয়া ৩ শতাংশ জমিতে একটি জরাজীর্ণ ঘরে দুই নাতনিকে নিয়ে বসবাস করছেন। গ্রামের এবাড়ি-ওবাড়ি গিয়ে অসহায় নাতনিদের দেখিয়ে কিছু সাহায্য–সহায়তা এনে নাতনিদের লালন–পালন করছেন তিনি।

গত সোমবার সকালে সরেজমিনে সদর উপজেলার চরজঙ্গলদী গ্রামে দেখা যায়, দাদি ফিরুজা একটি টিনের জরাজীর্ণ ঘরে দুই নাতনিকে নিয়ে বসে আছেন। ফিরুজার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জেসমিন ও ইয়াসমিন জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। এখন কিছুটা সুস্থ হয়েছে। তবে শারীরিকভাবে তারা বেশ দুর্বল। এই দুই অবুঝ শিশু দাদির কোলে বসে লবণপানি দিয়ে বানানো স্যালাইন খাচ্ছে। পুষ্টিকর খাবারের অভাবে এই দুই শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।

ফিরুজা বলেন, ‘আড়াই মাস বয়সে আমার ছেলে ছামেদুল তার দুই যমজ মেয়ে জেসমিন-ইয়াসমিনকে আমার কাছে রাইখ্যা চইলা যায়। এরপর থাইকা আমি ওগরে বড় করতাছি। বাচ্চা দুইডা মায়ের বুকের দুধ পায় নাই। তাই ওগরে জীবন বাঁচাবার লাইগা চাইলের গুঁড়ার সঙ্গে অল্প পরিমাণ লবণ মিশাইয়া পানি দিয়া বিকল্প দুধ বানাইতাম। আর ওই বিকল্প দুধ ফিডারে ভইরা বাচ্চা দুইডারে খাওয়াইছি। তবে মাঝেমধ্যে এলাকার দু-একজন গুঁড়া দুধ কিনা দিছে। সেই দুধ খাওয়াইছি। আমি তো গরিব মানুষ। বাচ্চা দুইডারে কোনো সময় ভালো খাবার খাওয়াইতে পারি নাই। কোরবানির ঈদে সমাজ থাইকা গরুর মাংস দিছিল। সেই মাংস রান্না কইরা বাচ্চা দুইডা রে খাওয়াইছি।’

ফিরুজা আরও বলেন, তিনি সরকার থেকে বয়স্ক ভাতা হিসেবে মাসে ৫০০ টাকা পান। কিন্তু সেই টাকায় তো সংসার চলে না। তাই ভিক্ষা করে নাতনি দুটিকে লালন-পালন করছেন। অবুঝ দুটি শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার ও তাঁকে একটি ঘর করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান তিনি।

ফিরুজার প্রতিবেশী চরজঙ্গলদী গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, বিধবা ফিরুজা অতিদরিদ্র। তাঁর নিজের কোনো আয় নেই। মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে দুটি অসহায় শিশুকে বড় করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এই পরিবারকে একটি ঘর ও প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা দেওয়া হলে শিশু দুটির ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে। নইলে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি সদস্য জামিউল হক বলেন, গরিব ফিরুজা ও তাঁর দুই যমজ নাতনির বিষয়টি তিনি জানেন। চলতি অর্থবছরে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কোনো বরাদ্দ তাঁদের পরিষদে আসেনি। বরাদ্দ পেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের সহায়তা করা হবে।