খুলনা মেডিকেল কলেজ
ক্যানসার ইউনিটে সেবা কম
প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলের অভাব। বর্তমানে বহির্বিভাগে শুধু কেমোথেরাপি, সার্জারি, নতুন রোগী দেখা ও ফলোআপ কার্যক্রম চলছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসায় রয়েছে আলাদা ইউনিট। নাম রেডিওথেরাপি ও অনকোলজি বিভাগ। প্রতিবছর সেখানে রোগীর চাপ বাড়ছে। তবে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলের অভাবে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। ইউনিটের ১২ শয্যার ৮টিই বিভিন্ন বিভাগ থেকে ধার করে আনা। বর্তমানে বহির্বিভাগে শুধু কেমোথেরাপি, সার্জারি, নতুন রোগী দেখা ও ফলোআপ কার্যক্রম চলছে। তবে রোগীদের সরকারিভাবে কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না।
দক্ষ জনবল ও অবকাঠামো না থাকায় হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেওয়ার একটি যন্ত্র ১১ বছর ধরে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে। পাশেই বানানো হচ্ছে বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল।
সেবাপ্রার্থীরা বলছেন, কেমোথেরাপি ছাড়া হাসপাতাল থেকে তেমন সহযোগিতা করা হয় না। তা ছাড়া কেমোথেরাপির পর রোগীদের রেডিওথেরাপি দিতে হয়। সেটা বাইরে করা অনেক ব্যয়বহুল। তবে হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, রেডিওথেরাপি দিতে যে অবকাঠামো ও জনবল প্রয়োজন, সেটা বর্তমানে নেই। পরিপূর্ণ ইউনিট চালু হলে সমস্যার সমাধান হবে।
পর্যাপ্ত সেবা দিতে না পারায় রোগীরাও আশ্বস্ত হতে পারেন না। প্রায় ৫০ ভাগ রোগী ভারতে চলে যাচ্ছেন। এতে প্রতিনিয়ত দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে।
রেডিওথেরাপি ও অনকোলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে ইউনিটে নতুন রোগী এসেছিলেন ১ হাজার ৬০১ জন। আর গেল বছর সেই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬৫০। সব মিলিয়ে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে বছরে গড়ে পাঁচ হাজারের মতো মানুষ সেখানে সেবা নেন। বর্তমানে ৯ জন নার্স, ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ৫ চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, বর্তমানে যে রোগী আসছেন, সেটা এখনকার জনবল দিয়ে সামাল দিতে খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না। তবে রেডিওথেরাপি দিতে হলে জনবলের প্রয়োজন হবে।
হাসপাতালের মূল ভবনের পেছনের অংশে ইউনিটটি অবস্থিত। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, বিভাগের এক পাশে কেমোথেরাপি দেওয়ার কাজ চলছে। বারান্দা ও বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছেন রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা।
নড়াইলের নড়াগাতী থেকে স্ত্রীকে কেমোথেরাপি দিতে হাসপাতালে এসেছেন কাজী আবেদ আলী। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনই দরজির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্ত্রীর কেমোথেরাপি চলার সময় বারান্দায় বসেছিলেন তিনি। তিনি বলেন, গত বছরের জুনে তাঁর স্ত্রীর স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে। প্রতি ২১ দিন পরপর কেমোথেরাপি দিতে নিয়ে আসতে হয়। প্রতিবার কেমোথেরাপি দিতে পরীক্ষা ও ওষুধসহ ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
আবেদ আলী আরও বলেন, কেমোথেরাপির পর রেডিওথেরাপি দিতে হবে। বাইরের হাসপাতালে সেটি করতে খরচ হবে ৭০–৮০ হাজার টাকা। এত টাকা কোথায় পাব? হাসপাতাল থেকে কোনো ওষুধই দেওয়া হয় না। কেমোথেরাপি ছাড়া অন্য সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
আবেদের পাশেই বসেছিলেন মুজিবর রহমান। তিনিও স্ত্রীকে নিয়ে বাগেরহাটের মোংলা থেকে এসেছেন। মুজিবর রহমান বলেন, সরকারি হাসপাতাল হিসেবে কিছু ওষুধ পেলে রোগী ও তাঁর স্বজনেরা বেঁচে যেতেন। প্রতিবার কেমোথেরাপি দিতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধারদেনা করা লাগে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ও অনকোলজি বিভাগের প্রধান মো. মুকিতুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, যন্ত্রপাতি বলতে তেমন কিছু নেই। যা আছে তা দিয়েই বহির্বিভাগে সেবা দেওয়া হচ্ছে। কারও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করা হচ্ছে। এর বাইরে নিয়মিত কেমোথেরাপি দেওয়া হয় এবং নতুন ও পুরোনো রোগীদের চিকিৎসা ও ফলোআপ করা হয়। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত সেবা দিতে না পারায় রোগীরাও আশ্বস্ত হতে পারেন না। প্রায় ৫০ ভাগ রোগী ভারতে চলে যাচ্ছেন। এতে প্রতিনিয়ত দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে।
১১ বছর ধরে বাক্সবন্দী যন্ত্র
ক্যানসারের চিকিৎসায় ২০১২ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি শক্তিশালী রেডিওথেরাপি যন্ত্র দেওয়া হয়েছিল। ২৪ কোটি টাকা দামের লিনিয়র অ্যাকসেলেটর যন্ত্রটির বাক্সও খোলা হয়নি। যন্ত্রটির বিক্রয়োত্তর সেবার মেয়াদও ফুরিয়ে গেছে অনেক আগে। যন্ত্রটি সরিয়ে ফেলতে স্বাস্থ্য বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকবার চিঠি পাঠিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, যন্ত্রটি স্থাপনের জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন, তা হাসপাতালে নেই। তা ছাড়া যন্ত্র চালানোর মতো দক্ষ জনবলও নেই। একসময় মন্ত্রণালয় থেকে যন্ত্রটি ঢাকায় ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এর বদলে ‘কোবাল্ট-৬০’ নামের আরেকটি ছোট যন্ত্র দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াও স্থগিত হয়ে যায়।
হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের চিকিৎসকেরা বলেন, ২০১২ সালে যন্ত্রটি রাজধানীর মহাখালীর ক্যানসার হাসপাতাল থেকে খুলনায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কী কারণে পাঠানো হয়েছিল তা জানা নেই। এ জন্য হাসপাতাল থেকে কোনো চাহিদাপত্র দেওয়া হয়নি বলেও তাঁরা শুনেছেন।
নির্মাণ হচ্ছে বিশেষায়িত ক্যানসার হাসপাতাল
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের পাশেই হচ্ছে ২০ তলাবিশিষ্ট একটি ক্যানসার হাসপাতাল। সেখান থেকে কিডনি, কার্ডিওলজি ও ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া হবে। ২০২১ সালের আগস্টে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চলতি বছরের আগস্টের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে, ভবনটির বেজমেন্টের কাজ চলছে।
হাসপাতালের উপপরিচালক নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত দূর জানি ভবনটিতে সম্পূর্ণ আলাদা একটি হাসপাতাল হবে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র থাকবে না। সেখানে আলাদা পরিচালক থাকবেন। ওই ভবনের কাজ শেষ হতে আরও কয়েক বছর লেগে যাবে।’