জাফর আলমের ‘মাথাব্যথা’ ১০ প্রার্থী

সংসদ সদস্য জাফর আলম
ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলমের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অসন্তোষ নতুন নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের অনেকেই এখন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় লোকজনের ওপর অত্যাচার নির্যাতন, চিংড়ি ঘের ও জমি দখল, ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারানোর জন্য বিকল্প প্রার্থী দাঁড় করানো, বিএনপি নেতাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার ফরম জমা দিয়েছেন জাফর আলম। তাঁর মনোনয়ন ঠেকাতে ফরম জমা দিয়েছেন চকরিয়া-পেকুয়ার আরও ১০ জন প্রার্থী। নির্বাচনে এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন তাঁর ‘মাথাব্যথার’ কারণ হয়ে উঠতে পারেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।  

মনোনয়ন নিয়েছেন যাঁরা

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুল করিম সাঈদী, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য রাশেদুল ইসলাম ও  জিয়াউদ্দিন চৌধুরী, পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মহিউদ্দিন বাবর, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের জেলা শাখার সাবেক সভাপতি নুরুল আজিম কনক, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আমিনুল হক, জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রেসিডিয়াম এ এইচ সালাহউদ্দিন আহমদ এবং জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াছ। গতকাল মঙ্গলবার নৌকার মনোনয়ন ফরম পূরণ করে জমা দিয়েছেন তাঁরা।  

জোটের হিসাব-নিকাশ

জোটগতভাবে নির্বাচন হলে পাল্টে যেতে পারে মনোনয়নের হিসাব-নিকাশ। চকরিয়ার-পেকুয়া এলাকার রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করছেন—এমন কয়েকজনের মতে, জোটগতভাবে নির্বাচন হলে নৌকার মনোনয়ন জাতীয় পার্টির এ এইচ সালাহউদ্দিন মাহমুদ অথবা মোহাম্মদ ইলিয়াছের মধ্যে যেকোনো একজন পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে জাফর আলম মনোনয়ন না-ও পেতে পারেন। এ ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে এ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ ইলিয়াছ। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে তাই আবারও আসনটি চাওয়া হতে পারে। তেমন সিদ্ধান্ত হলে এই আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশ নেবেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে।

মাঠে আছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক

মাসখানেক ধরে ভোটের মাঠে তৎপর আছেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আমিনুল হক। গণসংযোগের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রার্থী হওয়ার কথা জানাচ্ছেন। হঠাৎ নির্বাচনে আসার কারণ জানতে চাইলে আমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর পুরো পরিবার আওয়ামী লীগ সমর্থক। বিচারক হিসেবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন শেষে এলাকার মানুষের সেবা এবং নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত এবং এলাকার সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন। জনসমর্থনও তাঁর পক্ষে।

জাফরের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

বিএনপি-জামায়াত-অধ্যুষিত এ আসনে ৪৫ বছর পর আওয়ামী লীগের চকরিয়া উপজেলা সভাপতি জাফর আলম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দলের নেতারা বলছেন, সংসদ সদস্য হয়েই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। মতের মিল না হলে দলের লোককেও ছাড় দেন না তিনি। বিএনপি-জামায়াতের লোকজন নিয়ে জাফর আলম নিজস্ব বলয় তৈরি করে চিংড়ি ঘের ও মানুষের জায়গাজমি দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। ২০২১ সালে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ২৫টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকার প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটে। যেসব ইউপিতে নৌকা হেরেছে, তার বেশির ভাগ ইউপিতেই বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন জাফর আলমের পছন্দের প্রার্থী।

৭ নভেম্বর চকরিয়া আদালতের এক আইনজীবীর চেম্বারে হামলা হয়। হামলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতা মাতামুহুরী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাহারবিল ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মহসিন বাবুল ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল দরবেশী আহত হন। হামলায় আহত আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, জাফর আলমের লোকজন এই হামলা চালিয়েছেন। এর প্রতিবাদে ৮ নভেম্বর কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ওই তিন নেতা জাফর আলমের সন্ত্রাসী বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধার ও চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানান।

সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের নেতা মহসিন বাবুল বলেন, জাফর আলমের নির্দেশে তাঁর ভাতিজা জিয়াবুল হক, ভাগনে মিজানুর রহমান, স্থানীয় যুবলীগ কর্মী শওকত ওসমানের নেতৃত্বে কয়েকজন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী তাঁদের ওপর হামলা চালায়। তিনি চিংড়ি ঘের দখল এবং চিংড়ি ঘেরমালিকদের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করছেন বলেও অভিযোগ করেন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নেতারা। জাফরের এই স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নির্বাচনে তিনি এলাকায় দলীয় সমর্থন পাবেন না বলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেছেন।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংসদ সদস্য জাফর আলম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে দলের বিচ্ছিন্ন কিছু নেতা তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এবারের মনোনয়নও তিনি পাচ্ছেন বলে দাবি করেন জাফর আলম। তিনি বলেন, বিএনপি-অধ্যুষিত এই আসনে তিনি ছাড়া নৌকাকে জিতিয়ে আনার লোক নেই। এখন যাঁরা মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন, তাঁদের সবাই বসন্তের কোকিল। এসব মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কারোরই এলাকায় জনসমর্থন নেই। তারপরও তাঁদের অধিকার আছে মনোনয়ন চাওয়ার। শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।