রাজশাহীর সেই পাহাড়িয়া মহল্লায় মানবাধিকারকর্মীরা, ভূমি কমিশন গঠনের তাগিদ

রাজশাহী নগরের মোল্লাপাড়ায় পাহাড়িয়াদের মহল্লায় ঢাকা থেকে আগত মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকেরা। রোববার সকালেছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী নগরের মোল্লাপাড়ায় পাহাড়িয়া মহল্লায় গিয়ে পাহাড়িয়াদের কথা শুনেছেন ঢাকার মানবাধিকারকর্মীরা। তাঁরা পাহাড়িয়াদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, দেশবাসী তাঁদের সঙ্গে আছেন। তাঁরা যেন ভয় না পান। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মানবাধিকারকর্মীরা সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন।

রোববার সকালে ঢাকা থেকে রাজশাহীর এই মহল্লায় আসেন চরচা ডটকমের সম্পাদক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হাসান, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, ব্লাস্টের প্রধান কার্যালয়ের প্রতিনিধি মিনহাজুল কাদির ও গ্রিন ভয়েসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আহসান হাবিব।

মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে ছিলেন ব্লাস্টের রাজশাহীর সমন্বয়কারী সামিনা বেগম, সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব ভলান্টারি অর্গানাইজেশনের (সিসিবিভিও) সমন্বয়কারী আরিফ ইথার, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতা সূভাষ চন্দ্র হেমব্রম ও আদিবাসী ছাত্র পরিষদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর সম্পাদক পলাশ কুমার মাহাতো। তাঁরা পাহাড়িয়াদের সরদার বাবুল বিশ্বাসের কাছ থেকে সবকিছু শোনেন।

এর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, ‘এই পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের মানুষগুলো এখানেই জন্ম নিয়েছেন। তাঁদের বাপ-দাদের এখানেই মৃত্যু হয়েছে। একটা আইন আছে যে যাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে এক স্থানে বাস করেন, সেখানে তাঁদের অধিকার জন্মায়। হঠাৎ কেউ একজন এসে বলছেন, তিনি এই জমির মালিক। এটা দেখে আমরা বিভিন্ন জায়গায় কথা বলেছি। এখানে এসেছি সংহতি প্রকাশ করতে। পাহাড়িয়া সম্প্রদায় একা নয়, আমরা তাদের সঙ্গে আছি।’

জাকির হোসেন বলেন, ‘সাজ্জাদ আলী নাকি ১৯৯৪ সালে এই জমি কিনেছেন, আগে তো তিনি দাবি করেননি। হঠাৎ করে কেন? আমাদের কথা হচ্ছে, মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। কেউ একজন এসে মালিকানা দাবি করবেন, এটা হয় না। আমাদের মনে হচ্ছে, যিনি দাবি করছেন, তিনি আসল মালিক নন। যিনি আসল মালিক ছিলেন, তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাজ্জাদ কী করে এত দিন পর এসে দাবি করেন? আসল মালিক যদি জমি ছেড়ে চলে যান, তাহলে এটা সরকারি হবে। এটার পাশে বড় সরকারি রাস্তা আছে। এখন প্রভাবশালীর চোখ পড়েছে। আমরা চাই, এদের নামে জমিটা রেকর্ড করে দেওয়া হোক।’

সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে জাকির হোসেন বলেন, ‘সমতলের আদিবাসীদের জন্য একটা ভূমি কমিশন দরকার। এটার পক্ষে সবার জোরালো সমর্থন আছে, কিন্তু হচ্ছে না। এখনো বৈষম্য তো প্রতিদিনই চলছে। সরকার বিভিন্ন কমিশন করেছে। কিন্তু আমরা উত্তরবঙ্গের একটা আদিবাসীর কোনো প্রতিনিধিত্ব কোনো কমিশনেই দেখলাম না। সরকারের কাছে দাবি জানাই, দ্রুত কমিশন হোক এবং আদিবাসীদের একটা তালিকা হোক।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দীপায়ন খীসা বলেন, পরিবারগুলো স্বাধীনতার পর থেকেই এখানে আছে। কেউ তাদের উচ্ছেদ করেনি। কয়েক দিন আগে এক ব্যক্তি খাসি খাইয়ে তাদের বিদায় জানাচ্ছেন। এটা নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। তাঁরা সংহতি জানাতে এসেছেন। যেখানে স্বাধীনতার পর কেউ তাদের উচ্ছেদ করেনি, এখন এসে কেন তাদের উচ্ছেদ করতে হবে? দ্রুত ভূমিদস্যুকে গ্রেপ্তার করতে হবে। এখানে ছোট একটা পুলিশ ফাঁড়ি হতে পারে, যাতে বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়ায় মুক্তিযুদ্ধের পর ছয়টি পাহাড়িয়া পরিবার বাড়ি করার সুযোগ পায়। তিন প্রজন্মে এখন বাড়ি হয়েছে ১৬টি। এত দিন পর সাজ্জাদ আলী নামের এক ব্যক্তি এই ১৬ কাঠা জমির মালিকানা দাবি করছেন। তিনি ১৬ পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে উচ্ছেদের আয়োজন করেছিলেন। তিনটি পরিবার কয়েক দিন আগেই বাড়ি ছাড়ে। গত শুক্রবার সেখানে খাসি কেটে খাইয়ে তাদের ‘বিদায়ের’ আয়োজন ছিল। রোববার ঘর ছাড়তে হতো বাকিদের। এ নিয়ে গত বুধবার পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয়। ভেস্তে যায় খাসি ভোজের আয়োজন।

পরদিন বৃহস্পতিবার তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ প্রশাসন। শুক্রবার সকালে ওই মহল্লায় যান আদিবাসী সংগঠনের নেতা-কর্মী, মানবাধিকারকর্মী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও উন্নয়নকর্মীরা। সেখানে তাঁরা মানববন্ধন করেন। খোঁজ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। লন্ডন থেকে তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের ফোন করে বিকেলে ওই মহল্লায় পাঠান।

পাহাড়িয়াদের বসতবাড়ি রক্ষার দাবিতে শনিবার বিকেলে সেখানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করেন ছাত্রদল ও যুবদলের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা একটি মানববন্ধনও করেন। একই সময় সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন করে রাজশাহীর বাম গণতান্ত্রিক জোট। এর আগে সকালে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে জাতীয় আদিবাসী পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।