খননেও স্বরূপে ফিরছে না নদী

খননের সময় কোনো নদীর প্রকৃত প্রস্থ মেপে দেখেনি পাউবো। নদী খননের কার্যক্রম অপরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত হয়নি বলে জানান নদী গবেষকেরা।

খননের পরও তলদেশ ভরে গেছে ঠাকুরগাঁওয়ের টাঙ্গন নদের। বর্ষা মৌসুমেও নেই পানি। সম্প্রতি সদর উপজেলার রাজাগাঁও এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গন-কুলিক-সুক-অহনা-তিরনই-নাগর-ভুল্লি-সেনুয়া-ভক্তি-পাথরাজ। এসব নদ-নদী ঘিরে রেখেছে ঠাকুরগাঁওকে। তবে দীর্ঘদিন ধরে দখল, দূষণ ও অবহেলায় বিপন্ন হতে বসেছে এসব নদ-নদী। প্রাণ ফেরাতে জেলার টাঙ্গন ও সুক নদী খনন করা হয়। কিন্তু তা কাজে আসেনি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, অপরিকল্পিত খননের জন্য আগের মতোই গেছে নদ-নদীগুলো।

পাউবো ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ছোট নদ-নদী, খাল ও জলাশয় খনন করে পানি সংরক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পের অধীনে ৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে টাঙ্গন, সুক, লাচ্ছি ও যমুনা খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া অন্য একটি প্রকল্পে সদর উপজেলার ভুল্লি, ঢেপা, কুলিক নদীও খনন করা হয়েছে।

২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকার চুক্তি মূল্যে টাঙ্গন নদের ৩৫ কিলোমিটার খনন করে ঘাস লাগানো ও ৭ হাজার গাছ রোপণের কাজটি পায় ঢাকার তাজুল-নিয়াজ জেভি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর ৬ কোটি ৯০ লাখ ৫২ হাজার টাকায় সুক নদীর ২৪ কিলোমিটার খননের কাজটি পায় এসআর অ্যান্ড জেএইচ জেভি নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

স্থানীয় লোকজন বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাঙ্গন ও সুক নদী থেকে খনন করা বালু স্তূপ করে নদীর পাড়েই রেখে দিত। বৃষ্টিতে সেসব বালু আবার ফিরে যায় নদীগর্ভে। আর এতেই খননের কাজ শেষ হতে না হতেই নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। ফলে নদীগুলো প্রাণ ফিরে পায়নি। এ সুযোগে সেখানে ধান চাষ শুরু করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

সদর উপজেলার রাজাগাঁও এলাকার টাঙ্গন নদীতে মাছ ধরেন আহসান আলী। তিনি বলেন, বছর আগে সারা বছর মাছ ধরেছেন। এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। খননের পরও পানি নেই।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুল আজিজ বলেন, দীর্ঘকাল ধরে এ দেশে নদীর পানিতেই চাষাবাদ হতো। নদীগুলো পনিশূন্য হয়ে পড়ায় বিকল্প সেচব্যবস্থা করতে হয়েছে। এতে শুধু সেচ খরচই বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া নদীতে পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১ জুলাই প্রকাশিত উচ্চ আদালতের এক রায়ে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রায়ে সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা এবং নদ-নদী সুরক্ষায় নদী রক্ষা কমিশনকে এর আইনি অভিভাবক ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণার পর দেশের নদ-নদী দখলমুক্ত করতে উদ্যোগ নেয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। ঠাকুরগাঁওয়ের নদ-নদী দখলদার ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পাউবো, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সমন্বয়ে গঠিত একটি দল। ওই দল জেলা শহরের বুক চিরে চলে যাওয়া সুক ও টাঙ্গন নদীর সীমানা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে দখলদার ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করে। তালিকায় ৩০৩ জন দখলদারের নাম উঠে আসে।

পাউবোর সূত্র জানায়, দখলদার ব্যক্তিদের মধ্যে ভূমিহীনেরা যেমন রয়েছেন, আবার প্রভাবশালীরাও রয়েছেন। কিন্তু দখলদারদের উচ্ছেদে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

নদী রক্ষায় কাজ করছে ‘রিভারাইন পিপল’ নামের একটি সংগঠন। ওই সংগঠনের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, নদী রক্ষার জন্য ১৯৪০ সালের সিএস নকশা অনুযায়ী নদীগুলোর সীমানা চিহ্নিত করা জরুরি। নদী ভরাট হোক, দূষণ-দখল যা–ই হোক, সেটিকে ধরে নদী পরিচর্যা শুরু করা উচিত। আর নদীতে পানি আসার যতগুলো উৎস, তার সবই উন্মুক্ত করে দিতে হবে।

আর পাউবোর নদী খনন প্রসঙ্গে তুহিন ওয়াদুদ বলেন, পাউবোর নদী খননের কার্যক্রম অপরিকল্পিত। তা ছাড়া সেটা বিজ্ঞানসম্মত হয়নি। খননের সময়ে কোনো নদীর প্রকৃত প্রস্থ মেপে দেখার প্রয়োজন তাঁরা মনে করেননি। যদি নদী শুধু খনন করা হয় আর নদীর পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হন, তাহলে নদী রক্ষা করা কঠিন হবে। সে জন্য ছোট নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার বিকল্প নেই।

এ বিষয়ে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, খাল ও নদী খননের কাজ শেষ হয়েছে। দরপত্র অনুযায়ী কিছু কাজ বাকি থাকায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৯ কোটি টাকার বিল কম দেওয়া হয়েছে।

অপরিকল্পিত খননের বিষয়ে তিনি বলেন,একটি বিশেষজ্ঞ দল এই প্রকল্প পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। সে ক্ষেত্রে প্রকল্পটি অপরিকল্পিত, তা বলার সুযোগ নেই। তবে মাটির ধরনের কারণে এ অঞ্চলের নদী খননের কাজ করতে সমস্যা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান জানান, জেলার নদী রক্ষায় তাঁরা কাঠোর অবস্থানে আছেন। নদী দখলের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।