২০ বছর ‘কুঁচিয়া’ ধরেই আসে ভাত-কাপড়ের জোগান

কুঁচিয়া মাছ ধরার ফাঁদ রুহুঙ্গা কাঁধে নিয়ে ছুটছেন সমীরণ। মৌলভীবাজার শহরের শমসেরনগর সড়কে
ছবি: প্রথম আলো

সকাল প্রায় ছয়টা বাজছে তখন। আষাঢ়ের মেঘলা আকাশ, মৃদু আলো আর হাওয়ায় বেশ কিছু মানুষ প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছেন। কিছু সিএনজিচালিত অটোরিকশা এই সময়ের মধ্যেই মৌলভীবাজার-শমসেরনগর সড়কের অটোরিকশা স্ট্যান্ডে এসে হাজির। চালকেরা বিভিন্ন গন্তব্যের নাম ধরে যাত্রীদের ডাকাডাকি করছেন। দুয়েকটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা এদিক থেকে ওদিক আসা–যাওয়া করছে।

গতকাল শনিবার সকালে এ রকম একটা সময়ে মৌলভীবাজার শহরের শমসেরনগর সড়কে হঠাৎই দেখা এক ব্যক্তির সঙ্গে। কাঁধে মাছ ধরার চাঁইয়ের মতো অনেকগুলো খাঁচা নিয়ে হেঁটে চলছেন সামনের দিকে কোথাও। তাঁর নাম সমীরণ (৪০)। বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আপার কাগাবলা ইউনিয়নের কাগাবলা গ্রামে। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে এখন থাকেন মৌলভীবাজার শহরতলির চাঁদনীঘাটে।

সমীরণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি ২০ বছর ধরে হাইল হাওরসহ বিভিন্ন স্থানে কুঁচিয়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর পরিবারের ভাত-কাপড়ের জোগান আসে প্রাকৃতিক উৎসের এই মাছ কুঁচিয়া ধরেই। ফাল্গুন মাস থেকে তাঁর কুচিয়া ধরার অভিযান শুরু হয়। চলে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। বাকি কার্তিক থেকে মাঘ এই চার মাস বাসা-বাড়িতে ঘুরে মাছ বিক্রি করেন। ফাঁকে ফাঁকে অল্প কিছু জমি আছে, তাতে ধান চাষ করেন। মাছ মারা পেশা হলেও কী করে যে একটা সময় কুঁচিয়া ধরার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, এখন আর তা মনে নেই।

সমীরণ বলেন, ‘আগে কেউ কুঁচিয়া ধরত না, আমরাও ধরছি না। কিন্তু বিদেশে এটা খায়, দামেও বেচা যায়। অখন (এখন) ধরইন (ধরেন) ২০ বছরের কম না, আমি কুঁচিয়া ধরছি। ভাটি এলাকায় মারে (শিকার করে) দেখে নিজে শিখছি।’

মাছটির নাম ‘কুঁচিয়া’ হলেও বিভিন্ন স্থানে কুঁইচা, কুইচ্চা, কুঁচে, কুঁচো নামেও পরিচিতি আছে। সমীরণ বলেন, কুঁচিয়া মাছ ধরার ফাঁদটির নাম ‘রুহুঙ্গা’। এটি বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি। এটি দেখতে অনেকটা মাছ ধরার চাঁইয়ের মতো হলেও চাঁই না। তবে কোনো কোনো এলাকায় এই ফাঁদকে ‘উকা’ নামেও ডাকা হয়।

কুঁচিয়া ধরার কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে সমীরণ বলেন, মৌলভীবাজারের বড়লেখা এলাকা থেকে তিনি ৭০ টাকা দরে রুহুঙ্গা কিনে নিয়ে এসেছেন। আগের দিন বেলা তিনটা থেকে চারটার দিকে স্যাঁতসেঁতে জমি, খালের যেখানে কিছু পানি লেগে আছে; তেমন স্থানে কেঁচো টোপ দিয়ে রুহুঙ্গা পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। সারা রাত এগুলো ওই জায়গাতেই থাকে। জিরের টোপ খেতে এসে রুহুঙ্গার ফাঁদে আটকা পড়ে কুঁচিয়া। আর বের হতে পারে না। পরদিন সকালের দিকে এসে রুহুঙ্গা তোলেন। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি রুহুঙ্গা পেতে রাখেন তিনি। সব কটিতেই কুঁচিয়া ধরা পড়ে না। কোনো কোনো দিন অনেকগুলো কুঁচিয়া পাওয়া যায়, কোনো কোনো দিন কম। তবে একবারে খালি হাতে কোনো দিনই বাড়ি ফিরতে হয় না।

কুঁচিয়াগুলোকে জীবিত রাখতে ড্রামের মধ্যে পানিতে রাখা হয়। সপ্তাহে দুই দিন পাইকার এসে বাড়ি থেকে তা নিয়ে যান। এক কেজি কুঁচিয়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দামে বিক্রি করেন।

সমীরণ বলেন, ‘কুঁচিয়া ধরায় কষ্টও আছে। জির (কেঁচো) তোলা, এগুলা (রুহুঙ্গা) বিভিন্ন জায়গায় নিয়া (নিয়ে) পাতানি (পাতানো)। কোনো মাসে ৫০ হাজার টাকাও মিলে, কোনো মাসে পাঁচ হাজারও অয় (হয়) না। ওটার (কুঁচিয়া বিক্রি) আয় দিয়ে আমার সংসার চলে। কুঁচিয়া মাছ ধরতে কোনো বাধা নাই। মাঝেমধ্যে নিজেও খাই। খুব স্বাদ।’

মৌলভীবাজার শহরের একটি জায়গা থেকে ২০ থেকে ২৫টার মতো রুহুঙ্গা তুলে নিয়ে এসেছেন সমীরণ। সেগুলোই তাঁর কাঁধে। তাতে দুই থেকে তিন কেজির মতো কুঁচিয়া পাওয়া গেছে। এগুলো একটি বাজারের থলের মধ্যে রেখেছেন। মাছগুলো থলের মধ্যে নড়াচড়া করছে। বাকি পাতানো রুহুঙ্গা তুলতে শমসেরনগর সড়কসংলগ্ন সৈয়ারপুর এলাকার একটি খেতের মধ্যে নেমে গেলেন সমীরণ। ওই খেতে স্যাঁতসেঁতে পানি জমে আছে। কচুরিপানা, নানা রকম ঘাসে ছাওয়া। হাঁটুসমান কাদায় পা গেড়ে যায়। কাদা ঠেলে পাতানো রুহুঙ্গার কাছে গিয়ে একেকটা রুহঙ্গা তোলেন, আর কাঁধের অন্যগুলোর সঙ্গে সেগুলোকে রাখেন। কোনোটিতে কুঁচিয়া মিলে, কোনোটি খালি।

অনেকটা বাইম মাছের মতো কুঁচিয়া। সাধারণত পুকুর, হাওর-বাঁওড়, খাল বা ধানখেতের তলদেশে, মাটির গর্তে এগুলো থাকে। স্থানীয় মানুষের খাদ্যতালিকায় মাছটি না থাকলেও বিদেশে এই মাছের বেশ চাহিদা আছে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে এই মাছ সংগ্রহ করে সমীরণের মতো অনেকেই বিক্রি করেন।