প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি কিংবা পূর্ব বাংলার প্রথম পত্রিকা ‘রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ’ সাক্ষ্য দেয়, শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় রংপুর কতটা এগিয়ে ছিল। রংপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতির অনুসন্ধান করলে পাবলিক লাইব্রেরি ছাড়াও উঠে আসে ব্যক্তিমালিকানাধীন কিছু বইয়ের দোকানের কথা; যেগুলো শুধু বইয়ের দোকান ছিল না, ছিল জ্ঞানচর্চার আড্ডাখানা। অধিকাংশ এখন অধুনালুপ্ত। তবে স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে ইস্ট বেঙ্গল লাইব্রেরি।
কথাগুলো বলছিলেন বৃহত্তর রংপুরের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক মোস্তফা তোফায়েল হোসেন। রংপুরের পুরোনো এই বইয়ের দোকানটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৫ সালে, দেশভাগেরও আগে। প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ইয়াকুব মিয়া। প্রতিষ্ঠানটি এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে। ইয়াকুব মিয়ার মেজো সন্তান এ কে এম জায়েদুল হক (জাহাঙ্গীর) বাবার ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
চুয়াত্তরোর্ধ্ব জায়েদুল হক স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ১৯৬৩ কি ১৯৬৪ সাল। তখন তাঁর বয়স ৯–১০ বছর। কলকাতা থেকে ট্রেনে করে বই এসেছে। বাবার সঙ্গে কিশোর জায়েদুল রংপুর রেলস্টেশনে যান সেই বই আনতে। কাস্টমস (শুল্ক বিভাগ) পার হয়ে বই আসত দোকানে। কলকাতা থেকে ট্রেনে করে বই আসার স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি।
ইস্ট বেঙ্গল লাইব্রেরি ছাড়াও ওসমানিয়া লাইব্রেরি, প্রভেনশিয়াল লাইব্রেরি, টাউন লাইব্রেরি, বাণী মঞ্জিলসহ হাতে গোনা কয়েকটি লাইব্রেরি ছিল। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত টাউন লাইব্রেরি ছাড়া অন্যগুলো অধুনালুপ্ত।
লেখক মোস্তফা তোফায়েল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ১৯০৫ সালের দিকে রংপুরে একটি সাধারণ পাঠাগার ছিল রঙ্গপুর ধর্মসভাকে ঘিরে। এই পাঠাগারের কর্ণধার ছিলেন পুঁথিসংগ্রাহক ও সাহিত্যিক যাদবেশ্বর তর্করত্ন। ‘রঙ্গপুর ধর্মসভা’ সে সময় ছিল জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানোর কেন্দ্র। এর আশপাশে বইয়ের দোকানগুলো গড়ে ওঠে।
বইয়ের ব্যবসায় ৫৫ বছর
১৯৭০ সালে জায়েদুল হক ছিলেন রংপুর জিলা স্কুলের ১০ম শ্রেণির ছাত্র। বাবা ইয়াকুব আলী অসুস্থ হলে ব্যবসা সামলানোর ভার তাঁর কাঁধে পড়ে। ওই বছরের শেষের দিকে দোকানে যাওয়া-আসা শুরু করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর পুরোদমে যুক্ত হন ব্যবসায়। কারমাইকেল কলেজে একাদশে বিজ্ঞান বিভাগের ভর্তি হলেও অধ্যয়ন বিরতি ঘটে। পরে রংপুর কলেজ থেকে (নাইট কলেজ) থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও মিঠাপুকুর কলেজ থেকে স্নাতক (পাস) সম্পন্ন করেন।
জায়েদুল জানালেন, ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপধ্যায় ছাড়াও নীহাররঞ্জন রায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই জনপ্রিয় ছিল। বগুড়ার লেখক রোমেনা আফাজের ‘দস্যু বনহুর’ বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘দস্যু বনহুর’, ‘দস্যু বাহরাম’, ‘দস্যু মোহন’—এসব কল্পিত ডাকাতের গল্পও পাঠক গোগ্রাসে পড়তেন।
সৃজনশীল বইয়ের ব্যবসা কলকাতা থেকে আমদানিমুখী ছিল বলে জানান জায়েদুল। বললেন, স্বাধীনতা–পরবর্তী দেশের প্রকাশনাশিল্প ও প্রকাশনদের উত্থান হয়। বই বিক্রির আগে পাঠক তৈরি করতে হয়। প্রকাশকেরা পাঠক তৈরি করতে পেরেছিল। তখন বইয়ের ব্যবসা কলকাতা থেকে ঢাকামুখী হয়। ঢাকা-রংপুর যাত্রীবাহী বাসে বই আসত তাঁদের দোকানে।
জায়েদুল হক জানালেন, স্বাধীন বাংলাদেশে কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা সিরিজ’ পাঠকনন্দিত হয়। আকবর হোসেন, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের ‘আনোয়ারা’ পাঠকপ্রিয় ছিল। ওই সময় বিনোদনের মাধ্যম ছিল নাটক, যাত্রা ও পুঁথিপাঠ। সন্ধ্যায় গ্রামে পুঁথিপাঠের আসর হতে। মুন্সী আবদুল করিমের ‘সোনাভানের পুঁথি’ ও কল্যাণ মিত্রের নাটকের বইগুলো ভালো বিক্রি হতো। নব্বইয়ের দশকে হুমায়ূন আহমেদ পাঠক তৈরি করেছিলেন বলে অভিমত দেন রংপুরের জ্যেষ্ঠ এ পুস্তক বিক্রেতা।
জায়েদুল হক বলেন, ২০১০ পর্যন্ত সাহিত্যের বইয়ের ব্যবসা ছিল। কিন্তু এরপর হাতে হাতে মুঠোফোন আসায় বিনোদন বিভক্ত হয়ে বইয়ের পাঠক কমে যায়। তাঁর মতে, বিক্রি কমে যাওয়ায় ছোট ছোট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। গ্রামের দোকানগুলোতে কসমেটিকস, খাতা, কলম বিক্রি করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ।
রংপুরের কয়েকজন বই ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে বংপুরে স্টেশন রোড, কারমাইকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে ১০০টির বেশি দোকান আছে। জায়েদুল বলেন, বইয়ের ব্যবসা গাইডমুখী হয়ে গেছে। বিভিন্ন শ্রেণির গাইড বই, ভর্তি পরীক্ষা, বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির বইয়ের বাইরে ক্ল্যাসিক (সৃজনশীল) বইয়ের পাঠক হাতে গোনা।
ইস্ট বেঙ্গল লাইব্রেরিতে রংপুরের বাসিন্দা নাজমুল হাসানের সঙ্গে কথা হয়। নাজমুলের নানি ফজিলাতুন নেসা (বুলু আপা নামে পরিচিত) ছিলেন রংপুরের একজন শিক্ষানুরাগী। ইস্ট বেঙ্গল লাইব্রেরি থেকে তাঁর নানি বাকিতে অনেক বই নিয়ে শিশু-কিশোরদের উপহার দিতেন বলে প্রথম আলোকে বলেন নাজমুল।
পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে
জায়েদুল হক তাঁর ব্যবসার অভিজ্ঞতার কথা স্মৃতিচারণা করে বলেন, সৃজনশীল পাঠক তৈরির পৃষ্ঠপোষক না থাকায় পাঠক কমে গেছে। তাঁর মতে, আগে রচনা প্রতিযোগিতা, পাঠচক্রসহ জ্ঞানচর্চার নানা অনুষ্ঠান থাকত। শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা এসব অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
জায়েদুল উদাহরণ দিয়ে বলেন, সত্তরের দশকে মোহাম্মদ আফজাল রংপুর পৌরসভার (বর্তমানে সিটি করপোরেশন) চেয়ারম্যান থাকাকালে অনেক শিক্ষার্থীকে বই উপহার দিতেন। কিন্তু এখন শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। অথচ বই উপহার দেওয়ার ট্রেন্ড (প্রচলন) উপেক্ষিত হয়েছে। সৃজনশীল বইয়ের পাঠক বাড়াতে পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প নেই।
মোহাম্মদ আফজালের বয়স ৯০ ছুঁই ছুঁই। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বললেন, দেশ স্বাধীনের পর রংপুর উন্নয়ন কমিটি নামে একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন তাঁরা। ওই সময় কৃতী শিক্ষার্থীসহ যাঁরা সংগীত, নাটক, খেলাধুলা ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে পারদর্শী থাকতেন, তাঁদের বই উপহার দেওয়া হতো।
আলাপের শেষ পর্যায়ে জায়েদুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর ব্যবসায় কোনো আনন্দদায়ক স্মৃতি আছে কি না। জায়েদুল উত্তর দিলেন, ক্রেতার চাহিদার বই সরবরাহ করে দেওয়া আনন্দের বিষয়। তাঁর মতে, ব্যবসায়ের মূলধন হলো বিশ্বাস ও সততা। তিনি তা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে চান। জায়েদুল হক আরও বললেন, ‘ওই যে নীহাররঞ্জন, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, রিক্তের বেদনের গোপাল বসাক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণের মতো লেখকদের সাহিত্যকর্ম মনে গেঁথে আছে, বিক্রেতা থেকে বিদগ্ধ পাঠক হওয়া, সেটাও একজীবনে কম কী।’