পূজার সাঁওতালি নাচে মাতোয়ারা পাহাড়ি পাড়া

দুর্গাপূজা উপলক্ষে পাহাড়ি গ্রামে গ্রামে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করে দলটি। শনিবার দুপুরে পানছড়ি কানুনগোপাড়া এলাকায় বড় সাঁওতালপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

সুসজ্জিত দলের সদস্যরা দোল, মাদল, দোতারা, বাঁশি বাজাতে বাজাতে পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। একপর্যায়ে তাঁরা গিয়ে উপস্থিত হন পাহাড়ের গায়ে থাকা স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর একটি পরিবারের বাড়ির উঠানে।

তাঁদের দোল-মাদলের বাদ্য দূরের পাহাড়েও ছড়িয়ে পড়ছিল। কাছে যেতেই শোনা গেল ‘আতো গাতি কুরি কোড়া, মায়া জালাং ছাড়া কিদেই, মায়া জালাং ছাড়া কিদেই, ইনদ ভেদ কান বোঙ্গা দেউড়ে’। অর্থাৎ গাঁয়ের যত যুবক-যুবতী, আটকা ছিলাম মায়ায় তাঁদের, এখন আমার যাওয়ার পালা, ছিঁড়ল মায়া।

নাচ শেষ হলে গৃহবধূরা আবদার করেন বান (খেলা) দেখানোর জন্য। আবদার পূরণ শেষ হলে উপহার হিসেবে পানীয়, টাকা, চালসহ নানা ফলমূল দেন গৃহস্থরা। শনিবার দুপুরে পানছড়ি কানুনগোপাড়া এলাকায় বড় সাঁওতালপাড়ায় গিয়ে এ দৃশ্যের দেখা মেলে।

দলের সদস্য আকাশ সাঁওতাল ও রাম সাঁওতাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসময় পূজার ১৫ দিন আগে থেকে বিভিন্ন পাড়ায় গিয়ে নাচতাম। কিন্তু বর্তমানে কাছাকাছি পাড়াগুলোতে নৃত্য করছি। দলে ৭ থেকে ৭০ বছর বয়সী ৩০ জন সদস্য রয়েছে। গৃহস্থের বাড়ি থেকে পাওয়া উপহারসামগ্রী দশমীর পরদিন তিন ভাগ হয়। দুই ভাগ দেওয়া হয় মন্দিরে। আর এক ভাগ আমরা সবাই মিলে আয়োজন করে খাই।’

দলটির সদস্যদের সবাই পুরুষ। তাঁদের পরনে সাদা ধুতি ও একই রঙের জামা। মাথায় সাদা পাগড়ি। তাতে নানা ফুল ও মুরগির পালক বসানো। তবে দলপ্রধানের সাজ ভিন্ন। তিনি পরেছেন গেরুয়া রঙের জামা ও ধুতি। মাথায় গেরুয়া রঙের পাগড়ি—তাতে মুকুট বসানো। আর হাতে ঝুড়ি। তাতে তুলসী, বেলপাতা, ধূপ, ফুল ও শিব ঠাকুরের ছবিসহ পূজার সরঞ্জাম।  

দলটির এক প্রবীণ সদস্য বলেন, দুর্গাপূজা বা যেকোনো মাঙ্গলিক উৎসবে তাঁরা এই নাচ করেন। একসময় যুদ্ধযাত্রার আগেও এ নাচ করা হতো। তাঁদের বিশ্বাস, নাচ ঐশ্বরিক। দেবতাদের সহায়তায় তা মানবসমাজে বিস্তার লাভ করেছে। এই নাচের মধ্য দিয়ে তুষ্ট হন ‘দাসাই বঙ্গা’ বা দাসাই দেবতা। এতে পরিবার এলাকাবাসী ও সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি অটুট থাকে।

কথা হয় দলের হেড চিলা (নাচের প্রধান) সমার সাঁওতালের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি বাড়িতে গান-নাচ শেষ করে বাড়ির সদস্যদের দাবি অনুযায়ী, তাঁরা ১২ ধরনের বান (খেলা) দেখিয়ে থাকেন। গত দুই বছর করোনার কারণে শুধু নিয়ম রক্ষার্থে নেচেছেন। তবে এ বছর মহালয়ার পর থেকে পাড়ায় পাড়ায় নাচ শুরু করেছেন। নানা উপহারসামগ্রী দিচ্ছেন গৃহস্থরা। প্রতিদিন দূরদূরান্তের পাহাড়ি গ্রামগুলো থেকে ডাক আসছে।