ধাপে ধাপে চাষ করেন জাহাঙ্গীর, ১৩ বিঘা জমিতে লেটুস, থাইপাতা, চেরি টমেটো

বিটরুট বিক্রির জন্য প্রস্তুত করছেন কৃষক জাহাঙ্গীর হোসেন। সম্প্রতি রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার থালতা গ্রামেছবি: প্রথম আলো

চাকরির বেতনে সংসার চলত কোনোরকমে। ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকার বেতনে প্রতিটি খরচ হিসাব করে করতে হতো। অনেক সময় ৫০ টাকা খরচ করতেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে হয়েছে। সেই সময় পেছনে ফেলে চাকরি ছেড়ে কৃষি উদ্যোগে বদলে গেছে ৩৩ বছরের যুবক জাহাঙ্গীর হোসেনের জীবন।

রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার থালতা গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন। একসময় তিনি বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে চাকরি করতেন। রাজশাহী বিমানবন্দরে কর্মরত ছিলেন প্রায় ৯ বছর। ২০২১ সালে সেই চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি নামেন কৃষিকাজে। শুরুটা হয়েছিল মাত্র ১০ কাঠা জমিতে পুদিনাপাতা চাষ দিয়ে। পাঁচ বছরের মাথায় এখন তাঁর চাষ করা জমির পরিমাণ ১২ থেকে ১৩ বিঘা। এসব জমিতে চাষ করেছেন বিটরুট, পুদিনাপাতা, লেটুস, আইস লেটুস, থাইপাতা, চেরি টমেটো, রেড ক্যাবেজ, ক্যাপসিকাম ও বালচিং অনিয়ন।

চেনা পথ ছেড়ে ভিন্ন কিছু

জাহাঙ্গীর চাকরি ছেড়ে প্রচলিত ফসল চাষের পথে হাঁটেননি। তিনি বেছে নিয়েছেন চায়নিজ বিভিন্ন সবজি। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি জমিতে আছে বিটরুট। তিনি ১০ বিঘায় চাষ করেছেন বিটরুট। জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘ধান-গম কেজিতে দাম বাড়ে না, কিন্তু সবজিতে কেজিতেই দাম বাড়ে। এই চিন্তা থেকেই ভিন্নপথে হাঁটলাম।’ তিনি জানান, এই উদ্যোগে শুরু থেকেই পাশে ছিল পবা উপজেলা কৃষি অফিস। ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জালাল উদ্দিন দেওয়ান নিয়মিত মাঠে এসে পরামর্শ দিচ্ছেন। জানতে চাইলে জালাল উদ্দিন দেওয়ান বলেন, জাহাঙ্গীর খুব বিচক্ষণ কৃষক। তিনি বাজার বুঝে চাষ করেন, নিজেই বাজারজাত করেন। ধীরে ধীরে তিনি নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন।

ধাপে ধাপে চাষ

সব ফসল একসঙ্গে চাষ না করে ধাপে ধাপে চাষ করে ফলন বাজারে আনেন জাহাঙ্গীর। আগাম চাষ করা কয়েক বিঘার বিটরুট ইতিমধ্যে তুলে বিক্রি করেছেন। মাঠে কোথাও বিটরুট তোলার শেষ পর্যায়, কোথাও গাছ বড় হচ্ছে, আবার কোথাও সদ্য বীজ বপন করা হয়েছে। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সব একসঙ্গে বাজারে আনলে দাম পাওয়া যায় না। তাই পর্যায়ক্রমে চাষ করি, যেন সব সময় কিছু না কিছু বাজারে থাকে। বর্তমানে বিটরুটের পাইকারি দাম কেজিপ্রতি ৪০-৫০ টাকা। ভালো বাজার পেলে এক বিঘা জমি থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি সম্ভব। এতে জমি ভাড়াসহ খরচ পড়ে ৭০-৭৫ হাজার টাকা।’

পুদিনাপাতায় আলাদা বাজার

তিন বিঘা জমিতে পুদিনাপাতা চাষ করছেন জাহাঙ্গীর। বর্ষাকালে পুদিনাপাতার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বগুড়া, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় বাসের মাধ্যমে পুদিনাপাতা পাঠান তিনি। জাহাঙ্গীরের ভাষ্য, পুদিনাপাতা রেস্তোরাঁয় বিক্রি হয়। রাজশাহী ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় পুদিনাপাতা পাঠান। এই পাতা চাষে খরচ কম, আয় বেশি।

বর্তমানে তাঁর খামারে প্রতিদিন পাঁচজন শ্রমিক কাজ করেন। প্রয়োজনে আরও লোক নেন। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘একসময় আমি পরাধীন ছিলাম। অন্যের চাকরি করতাম। আজ আমার কাজ দিয়ে পাঁচটা পরিবার চলছে, এটাই আমার সবচেয়ে বড় অর্জন।’

সরেজমিনে মাঠে

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, শীতের সকালের রোদে থালতা গ্রামের মাঠজুড়ে কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের ব্যস্ততা। কয়েকজন শ্রমিক মাটির নিচ থেকে তুলে আনছেন লালচে বিটরুট। পাশে বস্তায় ভরে রাখা হচ্ছে সবজি। একটু দূরে কাঁচা সবুজের সারি পুদিনাপাতা। বাতাসে ভেসে আসছে তাজা সবজির গন্ধ। পাশাপাশি সারি সারি লেটুসপাতা নজর কাড়ছে। কৃষক জাহাঙ্গীর হোসেন মাঠে দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করছেন। কখনো বিটরুট তোলা দেখছেন, কখনো বস্তায় ভরছেন। আবার পুদিনাপাতার বস্তা ঠিকঠাক করছেন। স্থানীয় কৃষক তবুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের ফসল আগে এলাকায় কেউ করতেন না। জাহাঙ্গীরই শুরু করেছেন। এখন তিনি একাই ১০ বিঘায় বিটরুট চাষ করছেন। এলাকায় এ উদাহরণ হয়ে গেছে।’

ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে চাষাবাদ ও কর্মসংস্থান তৈরির স্বপ্ন জাহাঙ্গীরের। তিনি বলেন, ‘কষ্টের কোনো বিকল্প নেই। মাটি ধরলে মাটি আপনাকে ফিরিয়ে দেবে—এই বিশ্বাসেই সামনে এগোচ্ছি। চাকরির অনিশ্চয়তার জীবন ছেড়ে মাটির ওপর ভরসা রেখেছি।’ 

পবা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এম এ মান্নান বলেন, ‘জাহাঙ্গীর একজন শিক্ষিত উদ্যোক্তা। তিনি যে ফসলগুলো চাষ করছেন, সেগুলো লাভজনক ও ব্যতিক্রমী। আমরা নিয়মিত তাঁকে পরামর্শ ও সহযোগিতা দিচ্ছি। জাহাঙ্গীরের মতো উদ্যোক্তা যদি আরও বাড়ে, তাহলে কৃষি আরও আধুনিক হবে।’