‘আবার হরতাল-অবরোধ শুরু অইছে, আধমরা অবস্থা চলতাছে’

সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট এলাকায় দৈনিক মজুরিতে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের একাংশ। আজ সোমবার সকাল সাড়ে নয়টায়
ছবি: প্রথম আলো

‘আবার হরতাল-অবরোধ শুরু অইছে। কামকাজ বন্ধ হইয়া গেছে। আধমরা অবস্থা চলতাছে।’ এমন আক্ষেপ সাইদুল আহমদের (২৮)। তাঁর গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বীরগাঁও গ্রামে। ১২ বছর ধরে তিনি সিলেট শহরে থাকেন। এখন বাসা মোল্লাবাড়ি এলাকায়। প্রতিদিন শ্রম বিক্রি করে চলে তাঁর সংসার।

সাইদুল বলেন, জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ভবন ও রাস্তা নির্মাণে রাস্ত্রমিস্ত্রিকে সহযোগিতা, মাটির কাজসহ যাবতীয় শ্রমের কাজ তিনি করেন। তবে হরতাল-অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে কাজ নেই। এ অবস্থায় আয়হীন হয়ে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। এখন যদি নিয়মিত এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকে, তাহলে টানাপোড়েন আরও বাড়বে।

সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট এলাকায় লতিফ মঞ্জিলের রাস্তা-সংলগ্ন সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে আজ সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সাইদুলের সঙ্গে কথা হয়। সেখানে তখন ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক জড়ো হয়ে ছিলেন। শ্রমিকেরা বলেন, মদিনা মার্কেটের এই শ্রমের হাটে প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ শ্রমিক আসেন। সকাল ছয়টা থেকে শ্রমিকেরা জড়ো হতে শুরু করেন। কোদাল, টুকরি, খাবারের পোঁটলা নিয়ে শ্রমিকেরা অপেক্ষায় থাকেন। ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকায় তাঁরা দিনের হিসাবে মজুরিভিত্তিতে শ্রম দেন।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমনিতে শ্রমের হাটে আসা শ্রমিকদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ প্রতিদিন কাজ পান। তবে হরতাল-অবরোধ শুরু হওয়ার পর এতে ভাটা পড়ে। এ সময়টাতে গড়ে ৫ শতাংশ শ্রমিক কাজ পাচ্ছেন। বাকিরা বেকার আছেন। কাজ কমে যাওয়ায় হতাশায় ভুগছেন মদিনা মার্কেট দিনমজুর হাটের শ্রমিকেরা। নির্বাচন সামনে রেখে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কায় সে সময়টাতে কাজ মিলবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত দিনমজুরেরা।

পয়ষট্টি–ঊর্ধ্ব হারিছ উদ্দিনের কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে, ‘আইজ আষ্ট (আট) দিন ধইরা কামকাজ পাইতাছি না। বাসাভাড়া কই থাকি দিতাম, চিন্তায় ঘুম ধরে না।’ তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে তিনি সিলেট শহরে আছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। এখন মেয়ে, মেয়ের জামাই ও নাতির সঙ্গে নগরের গোয়াবাড়ি এলাকায় একটা বাসায় ভাড়া থাকেন। কাজ না পাওয়ায় তাঁর দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার হাসনাবাদ গ্রামের সফর আলী (২৫) নগরের পাঠানটুলা এলাকায় থাকেন। মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে একটি কক্ষে দুই হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন। ছয় মাস ধরে এই শ্রমের হাটে তিনি আসছেন। প্রতিদিন কাজ পেলেও হরতাল-অবরোধের সময়টাতে এক দিনও কাজ পাননি। সফর জানান, ঘরে মাসে ১০ হাজার টাকা খাবারবাবদই তাঁর খরচ হয়। এ ছাড়া অন্যান্য খরচ তো আছেই। এখন কর্মহীন হওয়ায় সংকট বেড়েছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কীভাবে চলবেন, সেটি নিয়ে তাঁর অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মদিনা মার্কেটের শ্রমের হাটের শ্রমিকদের প্রায় সবাই সুনামগঞ্জের বাসিন্দা। তবে তাঁরা এখন সিলেট নগরেই থাকেন। কেউ একা, কেউ পরিবার নিয়ে। ইট ভাঙা, নির্মাণকাজ, রাজমিস্ত্রির সহযোগী, বস্তা টানা, মাটি কাটা থেকে শুরু করে নানা কাজ তাঁরা করতে পারেন। একা অথবা দলবদ্ধ হয়ে তাঁরা কাজে যান।

মদিনা মার্কেট শ্রমের হাটে আড়াই বছর ধরে শ্রম বিকোতে আসেন মো. ওয়াহিদ। তাঁর গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার প্রতাপপুর। নগরের নূর মোহাম্মদ রোডে এক কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে মা ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। ঘর ভাড়াবাবদ তাঁর প্রতি মাসে খরচ হয় ২ হাজার ২০০ টাকা এবং খাওয়া বাবদ তাঁর গড়ে ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়। এখন কাজ না পাওয়ায় তাঁর কপালে ভাঁজ পড়েছে।

ওয়াহিদ বললেন, হরতাল ও প্রথম দফার অবরোধ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় দফার অবরোধে তিনি এক দিনও কাজ পাননি। প্রতিদিন শ্রমের হাটে এসে ফেরত গেছেন। প্রতিদিনের আয় দিয়ে চলার কারণে কর্মহীন হয়ে তাঁর অবস্থা খারাপ এখন। এমন অবস্থা চললে সামনের দিনগুলোতে কী খাবেন ও কীভাবে চলবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।