ঋণ পরিশোধের পরও দুই কৃষকের নামে জালিয়াতি করে আবার ঋণ দেখানোর অভিযোগ

জয়পুরহাট সদর উপজেলার রাকাবের পুরানাপৈল শাখায় ঋণ পরিশোধের পর জালিয়াতি করে আবার দুই কৃষকের নামে ঋণ দেখানোর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। গতকাল শনিবার জয়পুরহাট প্রেসক্লাবে লিখিত বক্তব্য পড়েন কৃষক আমিনুর রহমানছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল শাখায় ঋণ পরিশোধের পর দুই কৃষকের নামে জালিয়াতি করে আবার ঋণ দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে ভুক্তভোগী ওই দুই কৃষক গতকাল শনিবার জয়পুরহাট প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেই সঙ্গে তাঁরা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।

এ ঘটনায় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। জালিয়াতি করে ঋণ নেওয়ার ঘটনায় ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক, ক্যাশিয়ার ও সুপারভাইজার জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী দুই কৃষক। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা দুই কৃষকের নামে জালিয়াতি করে ঋণ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেছেন, নিয়ম মেনে শস্যঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী ওই দুই কৃষক হলেন হাফিজুল ইসলাম ও আমিনুর রহমান। হাফিজুল জয়পুরহাট সদর উপজেলার হালট্টি গ্রামের বাসিন্দা। আর আমিনুর রহমানের বাড়ি একই উপজেলার বড়তাজপুর গ্রামে। তাঁদের দুজনের অভিযোগ, তাঁরা শস্যঋণ পরিশোধ করেছিলেন। তাঁরা আবার ঋণ নিতে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন, তাঁদের দুজনের নামে ঋণ দেখানো হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কেউ ঋণ নেননি। জালিয়াতির মাধ্যমে তাঁদের নামে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। তাঁরা এ ঘটনার প্রতিকার চান। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি চান।

ভুক্তভোগী দুই কৃষকের লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, হাফিজুলের বাবা আবদুল রাকাবের পুরানাপৈল শাখায় শস্যঋণ নিয়েছিলেন। হাফিজুল তাঁর বাবার শস্যঋণের ৯০ হাজার টাকা গত ২২ ও ২৩ জানুয়ারি ৪৬ হাজার ৩৩৮ টাকা ব্যাংকে গিয়ে পরিশোধ করেন। এরপর হাফিজুল ব্যাংকে বন্ধক থাকা তাঁর বাবার নামীয় সব দলিল ফেরত নেন। পরে হাফিজুল তাঁর নামে থাকা ২৬ শতক জমি দিয়ে ৫০ হাজার টাকা ঋণের আবেদন করেন। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ও সুপারভাইজার তাঁকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ দিতে অপারগতা জানান। তিন মাস পর ব্যাংকে গিয়ে তাঁর নামে (হাফিজুল) ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা ঋণ উত্তোলনের কথা জানতে পারেন। এতে তিনি হতভম্ব হয়ে যান।

এদিকে আমিনুর রহমান ২০১২ সালে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ করছিলেন। গত বছরের ২১ আগস্ট ব্যাংক চেকের মাধ্যমে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ও নগদ ১৩ হাজার ১৩ টাকাসহ মোট ১ লাখ ৪৩ হাজার ১৩ টাকা ঋণ পরিশোধ করেন। আবার ঋণ নেওয়ার জন্য তিনি ব্যাংক থেকে কাগজপত্র ফেরত নেননি। গত ১৩ মে আবার ঋণ নেওয়ার জন্য আবেদন করতে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁর নামে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে, যা জালিয়াতি ছাড়া কিছু নয়।

আজ রোববার সকালে রাকাবের পুরানাপৈল শাখায় গিয়ে জানা যায়, গত ২৪ জানুয়ারি হাফিজুলের নামে ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ হাফিজুল তাঁর বাবার ঋণ পরিশোধের এক দিন পর তাঁর নামে ঋণ নিয়েছেন। একইভাবে আমিনুল ইসলামেরও ঋণ পরিশোধের এক দিন পর গত বছরের ২২ আগস্ট ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঋণ দেখানো হয়েছে। ঋণের টাকা তাঁদের দুজনের কারও ব্যাংক হিসাবে দেওয়া হয়নি। সরাসরি ভাউচারের মাধ্যমে তাঁদের ক্যাশ থেকে ঋণের টাকা দেওয়া হয়েছে। এই দুটি শস্যঋণ বিতরণের সময় আবদুল হান্নান ক্যাশিয়ারের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ সায়দাবাদ শাখায় বদলি হন। আর এ ঘটনায় জড়িত ব্যাংকের অস্থায়ী নিরাপত্তাকর্মী মো. মোস্তাফিজুর রহমান গত মার্চে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন।

নিরাপত্তাকর্মী মোস্তাফিজুর রহমান পুরানাপৈল এলাকার মামুনুর রশিদের কাছ থেকে ২২ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়েছেন, এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগে ১২ মে মামুনুর রশিদ জয়পুরহাট সদর থানায় মোস্তাফিজুরের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর ঋণ জালিয়াতির ঘটনার বিষয়গুলো প্রকাশ পাচ্ছে। এ রকম আরও ঘটনা আছে বলে ব্যাংকটির একটি সূত্রে জানা গেছে।

ভুক্তভোগী হাফিজুল ও আমিনুর রহমান জানান, তাঁরা কোনো ঋণ নেননি। তাঁদের জমির কাগজপত্র দিয়ে ভুয়া স্বাক্ষরে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণের টাকা কেউ উত্তোলন করেছেন। এ ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক, ক্যাশিয়ার ও সুপারভাইজার জড়িত আছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাকাবের পুরানাপৈল শাখার ব্যবস্থাপক আজমেরী হোসেন বলেন, তাঁরা নিয়ম মেনে ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়েছেন। পুরানাপৈল এলাকায় একটি চক্র রয়েছে। এই চক্রের অনেকেই ব্যাংকঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে চক্রটি ষড়যন্ত্র করছে।

ব্যাংকের অস্থায়ী নিরাপত্তাকর্মী মোস্তাফিজুর রহমানের বিষয়ে জানতে চাইলে আজমেরী হোসেন বলেন, মোস্তাফিজুর মার্চে চাকরি ইস্তফা দিয়ে চলে গেছেন। তিনি অনেক লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলে এখন শোনা যাচ্ছে। তাঁর খোঁজ করা হচ্ছে।

রাকাবের উপমহাব্যবস্থাপক জাফর আলী মল্লিক বলেন, রাকাবের পুরানাপৈল শাখায় ঋণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছেন। এ ঘটনায় জয়পুরহাট শাখা ব্যবস্থাপক মীর তৌফিক, ক্ষেতলাল শাখার ব্যবস্থাপক আব্দুল মালেককে নিয়ে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।