ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে পুকুর কেটে ফসলি জমির সর্বনাশ

নাটোরের বড়াইগ্রামে ফসলি জমিতে এক্সকাভেটর দিয়ে পুকুর কাটা হয়েছেছবি: প্রথম আলো

বিঘার পর বিঘা ফসলি জমির বুক চিরে কাটা হচ্ছে পুকুর। এসব পুকুরের মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। আবার খনন করা পুকুরে চলছে মাছ চাষ। অথচ সরকারি আইনে ফসলি জমিতে পুকুর খনন এবং ওই জমির মাটি দিয়ে ইট তৈরি—দুটিই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পুকুর কাটার এ যজ্ঞে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতারা।

জেলা কৃষি ও মৎস্য বিভাগ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ছয় বছর ধরে এ অবৈধ কর্মকাণ্ড চলছে নাটোরের বড়াইগ্রামে। এ সময়ের মধ্যে উপজেলায় আনুমানিক দুই হাজার বিঘা ফসলি জমিতে তিন হাজারের বেশি পুকুর খনন করা হয়েছে। পুকুর থেকে মাটি পরিবহনের জন্য জমিতে তৈরি করা হয়েছে দুই কিলোমিটার রাস্তা। এতে ফসলি জমি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, বড়াইগ্রাম উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাহাবুল সরদার, বড়াইগ্রাম পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক সাইদুল ইসলাম, বড়াইগ্রাম সদর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হায়দার আলী, ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সরওয়ার আলম ও ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে পুকুর কাটা হচ্ছে। ছয় বছরে তাঁরা পুকুর খনন করে কমপক্ষে ২৩০ কোটি টাকার মাটি বিক্রি করেছেন। তাঁরা প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় সাংবাদিকদের মাসোহারা দিয়ে নির্বিঘ্নে পুকুর খননের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কারণেই প্রশাসনকে এসব পুকুর খনন বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

তবে পুকুর খননে বাধা দেওয়া হয় বলে দাবি করে জেলা প্রশাসক শামীম আহম্মেদ বলেন, ‘প্রশাসনকে আইনের বিধি মেনে চলতে হয়। আমরা যখনই পুকুর কাটার খবর পাই, তখনই আইনানুগ পদক্ষেপ নিই।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার বড়াইগ্রাম, মৌখড়া, বনপাড়া, কালিকাপুর, ভবানীপুর, জোনাইল, আহম্মদপুর, তিরাইল, মানিকপুর, জুয়াড়ী ও তারানগর গ্রামে এক্সকাভেটর দিয়ে ফসলি জমিতে পুকুর খনন করা হচ্ছে। অথচ কৃষিজমি সুরক্ষা আইন-২০১৬ (খসড়া)–এর ৪(১) ধারায় বলা আছে, কৃষিজমি কোনোভাবেই তার ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এ ছাড়া ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ আইনের ৫ নম্বর ধারায় কৃষিজমি, পাহাড় ও টিলার মাটি কেটে ইট তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

পুকুর কাটা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু করার নেই জানিয়ে অধিদপ্তরের নাটোর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুকুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা জেলা প্রশাসকের এখতিয়ারাধীন। তবে পুকুর কাটার কারণে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার অভিযোগ পেলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’

জেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে বড়াইগ্রাম উপজেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬১৩ বিঘা আবাদি জমি ছিল। ছয় বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৫ হাজার ২৬৬ বিঘায়। এ সময় ২ হাজার ৩৪৭ বিঘা ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২ হাজার বিঘা ফসলি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর খনন করা হয়েছে। এ বিষয়ে নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান বলেন, পুকুর খননের কারণে জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন সুলতানা জানান, গত এক বছরে উপজেলায় ১ হাজার ১২ বিঘা আবাদি জমি কমে গেছে।

২০১৬ সালে বড়াইগ্রাম উপজেলায় পুকুরের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৮২। ছয় বছরে পুকুরের সংখ্যা বেড়ে ৩ হাজার ৪৫২ হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব বলছে, ২০১৬ সালে বড়াইগ্রাম উপজেলায় পুকুরের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৮২। ছয় বছরে পুকুরের সংখ্যা বেড়ে ৩ হাজার ৪৫২ হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘প্রতিনিয়তই পুকুরের সংখ্যা বাড়ছে। আমরা সুষম উন্নয়ন চাই। কৃষি জমি নষ্ট করে পুকুর খননের ব্যাপারে আমরা কৃষকদের উৎসাহ দিই না। তবু মানুষ পুকুর কাটছে। পুকুর কাটা বন্ধের দায়িত্ব প্রশাসনের।’

স্থানীয় সূত্র জানায়, জানুয়ারির শুরু থেকে তারানগর গ্রামে ১২০ বিঘা ফসলি জমিতে ৮টি পুকুর খনন চলছে। ১০টি খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে রাত-দিন পুকুর খনন চলছে। পুকুরের মাটি ট্রাক্টরে করে বিক্রি করা হচ্ছে। তারানগরের আবুল খায়ের, বাবু মোল্লা, আবদুল কাদের, হায়দার আলী, সারওয়ার আলম, জাহাঙ্গীর আলম, শমসের আলী, ইয়াকুব আলী, রবিউল ইসলাম পুকুর খনন করছেন।

পুকুর খননের মাটি পরিবহনের জন্য ফসলি জমিতে রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। বড়াইগ্রামের জুয়াড়ী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পেছন দিয়ে প্রায় ২০০ মিটার রাস্তা নির্মাণ করে কাঁচুটিয়া বিলের পুকুরের মাটি বহন করা হচ্ছে। এ ছাড়া মাটি পরিবহনের জন্য ভবানীপুর করমতালি ইটভাটার পাশে ৪০০ মিটার, আহম্মদপুর কামারদহ সড়কের পেছনে কবরস্থানের পাশে ৩০০ মিটার, কৈডিমা হাটসংলগ্ন এলাকায় ৫০০ মিটার ও পদ্মবিলের পাশে ফসলি জমিতে ৬০০ মিটার রাস্তা করা হয়েছে। প্রতিদিন পুকুর খননের বেশির ভাগ মাটি যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়।

নাটোরের বড়াইগ্রামের তারানগর গ্রামে মাটিবাহী ট্রলি চলাচলের জন্য ফসলি জমির মধ্যে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি খননযন্ত্রের মালিক বলেন, বড়াইগ্রামে ৪৬টি খননযন্ত্র দিয়ে মাটি কাটার কাজ চলছে। এ খননযন্ত্র দিয়ে প্রতি বিঘা পুকুর কেটে প্রায় এক হাজার ট্রাক্টর মাটি পাওয়া যায়। দূরত্বভেদে প্রতি ট্রাক্টর মাটি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। এ হিসাবে প্রতি বিঘা পুকুরের মাটি ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সে হিসাবে গত ৬ বছরে ২ হাজার বিঘা জমিতে পুকুর কেটে ২৩০ কোটি টাকার মাটি বিক্রি হয়েছে। এ টাকা মাটি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সাংবাদিক ও ভূমি কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগ–বাঁটোয়ারা করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পুকুর খনন করা হয়।

তারানগর গ্রামের সিঙ্গাইর বিলে ধান, রসুন ও ভুট্টার খেত। এর মধ্যে আটটি পুকুরের খননকাজ চলছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, তারানগর গ্রামের সিঙ্গাইর বিলে ধান, রসুন ও ভুট্টার খেত। এর মধ্যে আটটি পুকুরের খননকাজ চলছে। বিলের বাঁ পাশে কৃষক আবুল খায়েরের সাত বিঘা জমিতে খনন করা পুকুরের পাড় বাঁধার কাজ চলছে। সেখানে কর্মরত একজন শ্রমিক জানান, পুকুরটি কাটার দায়িত্ব নিয়েছেন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাহাবুল সরদার। ওই পুকুরের পাশেই বাবু মোল্লার আট বিঘা জমিতে পুকুর খনন চলছে। শ্রমিকেরা জানান, পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক সাইদুল ইসলাম পুকুরটি কাটার দায়িত্ব পালন করছেন।

সিঙ্গাইর বিলের দক্ষিণ অংশে ১৭ বিঘা ফসলি জমিতে পুকুর খনন করছেন জাহাঙ্গীর আলম, শমসের আলম ও ইয়াকুব আলী। পাশেই ১২ বিঘা জমিতে একটি পুকুর খনন করছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রবিউল ইসলাম। এসব পুকুরও দেখভাল করছেন ছাত্রলীগ নেতা সাহাবুল সরদার।

তারানগরের এক আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পুকুর কাটা নিয়ে এলাকায় কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চলছে। পুকুর কাটার আগে নেতারা জমির মালিককে প্রতি বিঘার জন্য এক লাখ টাকা করে দিচ্ছেন। পুকুর কাটা হয়ে গেলে চার বছর প্রতি বিঘার ইজারা বাবদ জমির মালিক পাবেন পাঁচ হাজার টাকা করে। পরে প্রতিবছর প্রতি বিঘার জন্য পাবেন ২০ হাজার টাকা। বিনিময়ে নেতারা পুকুরের মাটি বিক্রি করে দেবেন ও মাছ চাষ করবেন। বেশি টাকায় অন্যের কাছে পুকুর ইজারা দিতেও পারবেন।

একজন পুকুরমালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি নিজে পুকুর কাটার চেষ্টা করে পারিনি। প্রশাসন, পুলিশ, সাংবাদিক ও নেতারা বাধা দিয়েছেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে পুকুর খননের কাজ নেতাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। তাঁরা প্রশাসন, পুলিশ, সাংবাদিক ও বড় নেতাদের ম্যানেজ করার জন্য বিঘা প্রতি এক লাখ টাকা করে খরচ করেন বলে শুনেছি।’

ফসলি জমিতে পুকুর কাটার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগ নেতা সাইদুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি পুকুর কাটার ব্যবসা করি না।’ এ বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতা সাহাবুল সরদার বলেন, ‘ছাত্রলীগ করি বলে যেখানে যা হয়, তার সঙ্গে আমাদের জড়িয়ে অপপ্রচার চালানো হয়; বরং আমি ভেকু (খননযন্ত্র) চালানোর বিপক্ষে।’ খননযন্ত্র দিয়ে পুকুর তো কাটা হচ্ছে, আপনি তাতে বাধা দেন না কেন, জানতে চাইলে সাহাবুল সরদার বলেন, ‘বাস্তবে এসব কাজের সঙ্গে ক্ষমতাসীনেরা কেউ না কেউ জড়িত থাকেন। তাই ইচ্ছা থাকলেও আমি বাধা দিতে পারি না।’

এ বিষয়ে বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারিয়াম খাতুন বলেন, শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত করে পুকুর কাটা বন্ধ করা যাবে না। পুকুর কাটা বন্ধ করতে হলে ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।
মাটি ব্যবসায়ীরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পুকুর কাটছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে—এটা সত্যি কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার প্রশাসন কারও দ্বারা ম্যানেজ হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।’

বড়াইগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মমিন বলেন, ‘আমি  ফেব্রুয়ারি মাসে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় পুকুর কাটা বন্ধ করার জন্য দাবি জানিয়েছি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আমার দাবি সভার রেজল্যুশনে তোলা হয়নি।’