হাঁস চরিয়ে পাবনার দুলালের আয় লাখের বেশি

ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার টাকার ডিম বিক্রি করছেন দুলাল হোসেন।

পাবনার সাঁথিয়ার হুরাসাগর নদের পাড়ে খোলা জায়গায় হাঁস চরানো হচ্ছে। সন্ধ্যায় এসব হাঁস তোলা হয় নদের পাড়ের অস্থায়ী ঘেরে। গত ২৫ মার্চ তোলা ছবিছবি: প্রথম আলো

ফসলের মাঠ অথবা জলাভূমিতে সারা দিন একসঙ্গে চরানো হয় প্রায় ৭০০ হাঁস। সন্ধ্যা হতেই সেগুলোকে ঢোকানো হয় অস্থায়ী ঘেরে। সকালে সেই ঘেরে মেলে প্রায় ৫০০ ডিম। সেখান থেকেই প্রতিটি ডিম বিক্রি হয়ে যায় ১৩ থেকে ১৪ টাকায়। এভাবেই ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় সাত হাজার টাকার ডিম বিক্রি করছেন পাবনার ফরিদপুর উপজেলার বিলচান্দক গ্রামের দুলাল হোসেন। হাঁসের খাবারের দাম, শ্রমিকের মজুরি ও অন্যান্য সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে তাঁর আয় থাকে লক্ষাধিক টাকা।

সারা বছরই দুলাল হোসেন হাঁসের পাল নিয়ে এ জেলা থেকে সে জেলার ফসলের মাঠ ও জলাভূমিতে ঘুরে বেড়ান। এখন প্রায় ৭০০ হাঁস নিয়ে তিনি আছেন সাঁথিয়া উপজেলার আমাইকোলা গ্রামে হুরাসাগর নদের পাড়ে। এর আগে ছিলেন শাহজাদপুর উপজেলার চয়রা গ্রামের একটি ফসলের মাঠে। এখন যেখানে আছেন সেখানকার প্রাকৃতিক খাবার শেষ হলে হাঁসগুলো নিয়ে চলে যাবেন অন্য কোনো জায়গায়। এভাবেই ২০ বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার পরিচালনা করে সচ্ছলতার দেখা পেয়েছেন তিনি।

তবে শুধু দুলাল হোসেনই নন, অনেকেই এখন ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামারে ঝুঁকে পড়েছেন। লাভজনক হওয়ায় এই পদ্ধতিতে হাঁস পালনে আগ্রহীর সংখ্যা বাড়ছে। পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলার বিভিন্ন বিল এলাকার জমিতে দেখা মেলে এমন অনেক খামারের।

খাল-বিল, নদী অধ্যুষিত এ এলাকায় প্রাকৃতিক খাবারের প্রাচুর্য থাকায় হাঁস চাষের জন্য এ এলাকা দারুণ উপযোগী। ভ্রাম্যমাণ পদ্ধতিতে হাঁসগুলোকে সেই খাবার প্রায় বিনা মূল্যে খাওয়ানো যায় বলে এই পদ্ধতিটি লাভজনক।
মিজানুর রহমান, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, বেড়া

খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণ খামারের চেয়ে ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামারে বিনিয়োগ করতে হয় তুলনামূলক কম। ভ্রাম্যমাণ খামারে অবকাঠামো ব্যয় নেই বললেই চলে। হাঁস কেনা বাবদ যা ব্যয় হয়, সেটিকেই মূল বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। ৫০০ হাঁস আছে এমন একটি খামারে হাঁসের পেছনে বিনিয়োগ প্রায় তিন লাখ টাকা (প্রতিটি গড়ে ৬০০ টাকা হিসাবে)। এ ছাড়া অন্যান্য খাতে সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ১০ হাজার টাকা। ৫০০ হাঁসের একটি ভ্রাম্যমাণ খামারে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০টি ডিম উৎপাদন হয়। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এর দাম সাড়ে চার হাজার টাকা (প্রতিটি ১৩ টাকা হিসাবে)। খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টাকা আয় থাকে। 

সাঁথিয়ায় হাঁসের পাল নিয়ে আসা দুলাল হোসেন জানান, তাঁর খামারে হাঁস রয়েছে প্রায় ৭০০। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ ডিম পাচ্ছেন। তাঁর খামারের ডিমের আকার ভালো বলে খামার থেকেই প্রতিটি ১৩ থেকে ১৪ টাকা দরে বিক্রি করছেন। একজন শ্রমিক নিয়ে তিনি খামারটি চালান। শ্রমিকের মজুরি, হাঁসের খাবার, ওষুধসহ নানা ব্যয় মেটানোর পরেও প্রতি মাসে তাঁর লাখ টাকার কাছাকাছি আয় থাকছে। ২০ বছর ধরে তিনি ভ্রাম্যমাণ খামারের ব্যবসা করে আসছেন। একসময় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করলেও খামারের আয়ে তিনি পাকা বাড়ি, জায়গা, জমি করে সচ্ছলতার দেখা পেয়েছেন। 

খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভ্রাম্যমাণ খামার ভাগ্য ফিরিয়েছে অনেকের। তাঁরা জানান, সাধারণ খামারগুলোতে হাঁসের খাবারের পেছনেই লাভের বড় একটা অংশ চলে যায়। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ খামারের ক্ষেত্রে তা হয় না। খাল-বিল ও ফসলের মাঠে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যায় বলে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় সেগুলোর জন্য খাবার প্রায় কিনতেই হয় না।

ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামারগুলো মূলত ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যেই গড়ে তোলা হয়। এ কারণে খামারিরা বেশি ডিম দেয় এমন উন্নত জাতের হাঁস কিনে থাকেন। ৮ থেকে ৯ মাস বয়সের উন্নত জাতের একটি হাঁসের দাম পড়ছে এখন ৬০০ টাকার কাছাকাছি। তবে দুই-তিন বছর পর সেগুলোর ডিম দেওয়ার ক্ষমতা কমে এলে খামারিরা প্রতিটি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি করে থাকেন।

চাকলা গ্রামের বিলের জমিতে হাঁস চরাতে আসা সুজানগর উপজেলার চরগোবিন্দপুর গ্রামের মোক্তার হোসেন বলেন, ‘এক সময়ে দিনমজুরি কইর‍্যা কুনুরকমে সংসার চালাইত্যাম। পরে অন্যদের দেইখ্যা ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার করার জন্য এনজিওর থ্যা ঋণ নেই। আরেকজনের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ৫০০ হাঁস নিয়্যা খামার শুরু কইর‍্যা এখন সুখের দেখা পাইছি। সব ঋণ শোধ করার পর এখন ভালোই সঞ্চয় হইছে। আমার সংসারে এখন কুনু অভাব নাই।’ 

বেড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘খাল-বিল, নদী অধ্যুষিত এ এলাকায় প্রাকৃতিক খাবারের প্রাচুর্য থাকায় হাঁস চাষের জন্য এ এলাকা দারুণ উপযোগী। ভ্রাম্যমাণ পদ্ধতিতে হাঁসগুলোকে সেই খাবার প্রায় বিনা মূল্যে খাওয়ানো যায় বলে এই পদ্ধতিটি লাভজনক।’