ঠেকানো যাচ্ছে না মধু চুরি

সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনের কলাগাছিয়া এলাকায় মধু সংগ্রহ করছেন মৌয়ালেরাফাইল ছবি

সেরা মধুর কথা বলতে গেলে সুন্দরবনের মধুর নাম প্রথমেই আসে। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বন বিভাগ সুন্দরবনের এই মধু আহরণের অনুমতি দেয়। আর সে মধু আহরণে প্রতিবছর বন বিভাগের একটি লক্ষ্যমাত্রাও থাকে। কিন্তু এবার মৌসুম শুরুর আগেই সুন্দরবনে চুরি করে মধু সংগ্রহ চলছে। এতে বনের চাকগুলো মধুতে পূর্ণ হওয়ার আগেই সেসব কেটে ফেলা হচ্ছে। সাতক্ষীরার সুন্দরবনসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় এখন সুন্দরবন থেকে চুরি করে সংগ্রহ করা এসব মধু চড়া মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে।

চুরি করে মধু সংগ্রহের কারণে এসব মধু বন বিভাগের হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে আগাম চাক কাটার কারণে মৌসুমের চেয়ে মধু অনেক কম পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এবার বন বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা চুরি করে মধু সংগ্রহ ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে স্বীকার করেছেন। তাঁরা লোকবল সংকটের কারণে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় মধু চুরি ঠেকাতে পারছেন না দাবি করছেন। বন বিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাস (অনুমতি) নিয়ে জেলেদের ছদ্মবেশে মধুচোর চক্র প্রবেশ করছে। মৌসুমের আগেই বনে ঢুকে চুরি করে তারা ৪০-৫০ ভাগ মধু আহরণ করে ফেলছে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৮৬ সাল থেকে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে মধু আহরণের জন্য পাস দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের মধ্যে সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকেই প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি মধু আহরণ করা হয়। প্রতিবছর ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত দুই মাস মধু আহরণের মৌসুম। এ জন্য প্রতিবছর ১ এপ্রিল সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনে ‘মধু আহরণ উৎসব’ করে মৌসুমের উদ্বোধন করা হয়।

বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে ৪১১টি পাস নিয়ে ২ হাজার ৮৯৮ জন মৌয়াল ১ হাজার ৪৪৯ কুইন্টাল মধু এবং ৩৩৪ দশমিক ৭০ কুইন্টাল মোম আহরণ করেন। এ থেকে রাজস্ব আয় হয় ৩২ লাখ ৭৪ হাজার ৭০০ টাকা। ২০২৩ সালে ৩৬৫টি পাস নিয়ে ২ হাজার ৪৫০ জন মৌয়াল ১ হাজার ২২৫ কুইন্টাল মধু এবং ৩৬৭ দশমিক পাঁচ কুইন্টাল মোম আহরণ করেন। এ থেকে রাজস্ব আয় হয় ২৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা। চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৫০০ কুইন্টাল মধু এবং ৪৫০ কুইন্টাল মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সুন্দরবনের ভেতরে মৌমাছির চাক
ফাইল ছবি

শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী এলাকার মৌয়াল আবদুর রহমানের বয়স ৪৫ বছর। সুন্দরবন থেকে তিনি মধু আহরণ করছেন ২৫-২৬ বছর। তিনি জানান, সাধারণত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সুন্দরবনের মৌচাকে মধু আসা শুরু হয়। এপ্রিলের প্রথম থেকে মৌয়ালরা চাক কেটে মধু সংগ্রহ করেন। এপ্রিল মাসে প্রথমে একটি চাক থেকে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই কেজি মধু পাওয়া যায়। কিন্তু মৌসুমের আগেই মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহেও যদি এসব চাক থেকে আহরণ করা হয়, তখন মধু পাওয়া যায় ৪০০-৫০০ গ্রাম। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সপ্তাহে মধু আহরণ করলে একটি প্রমাণ আকারের চাক থেকে কমপক্ষে ৫-৭ কেজি মধু পাওয়া যেতে পারে।

সরেজমিনে গত রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী, নীলডুমুর, দাতিনাখালি, মুন্সিগঞ্জ, গাবুরা, কদমতলা এলাকা ঘুরে বেশ কয়েকটি স্থানে সুন্দরবনের মধু বিক্রি করতে দেখা গেছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জামান, বক্স, বাচ্চা খোকন, রুস্তুম, তোরাব, রফিকুল ও মাকছুদের নেতৃত্বে ১৫-২০টি দল মার্চ মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে সুন্দরবনে ঢুকে চুরি করে মধু আহরণ করছে। তারা মধু নিয়ে এসে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় চড়া মূল্যে বিক্রি করছে।

বুড়িগোয়ালিনী এলাকায় সুন্দরবনের মধু বিক্রি করছিলেন এক মৌয়াল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, তিনি ১০ বছর ধরে মৌসুমে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করছেন। তাঁরা চারজন ১৬ মার্চ সুন্দরবনে ঢুকে দুই মণ মধু আহরণ করেছেন বলে জানান। মৌসুমের আগেই চাক কাটলে মধু কম পাওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এপ্রিলের আগে চাকে মধু কম পাওয়া গেলেও বনে অনেক চাক পাওয়া যায়। ইচ্ছেমতো মধু আহরণ করা যায়। এ সময় একটি চাকে ৪০০ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত মধু পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে সুন্দরবনে খলিসা, লতা, হেতালি ও গরান ফুলের মধু সহজে সংগ্রহ করা যাচ্ছে। তাঁরা প্রতি কেজি মধু ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন বলে জানান। তবে এই মৌয়াল জানান, এসব চাক থেকে এপ্রিলের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে মধু আহরণ করলে প্রতি চাকে সর্বনিম্ন পাঁচ কেজি করে মধু পাওয়া যেত।

চানতে চাইলে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জ কর্মকর্তা নূরুল আলম বলেন, ১ এপ্রিল থেকে মধু আহরণ শুরু হয়। কিন্তু তার আগেই চুরি করে একাধিক চক্র মধু আহরণ করছে। চুরি বন্ধ করতে হলে মধু আহরণের দুই মাস সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাস (অনুমতি) বন্ধ রাখতে রাখতে হবে।

নূরুল আলম আরও জানান, যে চাকে কমপক্ষে পাঁচ কেজি মধু পাওয়া যেত, এপ্রিলের আগে মধু আহরণ করলে ওই চাকে ৫০০ গ্রামের বেশি মধু পাওয়া যায় না। সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে এপ্রিল-মে মাসে যে পরিমাণ মধু আহরণ হয়, চুরি করে আগেই তার ৪০-৫০ ভাগ মধু আহরণ করছে এসব চক্র। লোকবলসংকটের কারণে চুরি ঠেকাতে পারছেন না এই কর্মকর্তা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।