নওগাঁয় লাম্পি স্কিনের বিস্তারে কৃষকের দুশ্চিন্তা

ছয় দিনে জেলার বিভিন্ন স্থানে ৩০টি গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। 

লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত একটি গরু। গত শুক্রবার নওগাঁর পোরশার নিস্কিনপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

নওগাঁর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে গরুর লাম্পি স্কিন রোগ (এলএসডি)। গত সাত দিনে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত ৩০টি গরু মারা গেছে।

এতে গরু পালনকারীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। ভাইরাসজনিত এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে লিফলেট বিতরণ ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।

পশুচিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলা জানা গেছে, গরুর লাম্পি স্কিন ভাইরাসজনিত রোগ। এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। এ রোগে আক্রান্ত গরুর শরীরে প্রথমে জ্বর দেখা দেয় এবং খাবারের রুচি কমে যায়। জ্বর বেশি হলে নাক-মুখ দিয়ে লালা বের হয়, পা ও গলা ফুলে যায়। আক্রান্ত গরুর বুকের নিচে দুই পায়ের মাঝে পানি জমে। গরুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে চামড়ায় গুটি গুটি ক্ষত হয় এবং পচন ধরে।

সেই সঙ্গে চামড়া থেকে লোম উঠে যায়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নেওয়া শুরু করলে এ রোগে আক্রান্ত পশুর সুস্থ হতে প্রায় এক মাস সময় লাগে। বড় গরু লাম্পি স্কিন রোগে তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে থাকলেও বাছুর–গরু আক্রান্ত হলে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। 

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৭ জুলাই থেকে গত শনিবার পর্যন্ত ছয় দিনে জেলার নওগাঁ সদর, রানীনগর, মান্দা, বদলগাছি, পোরশা, পত্নীতলা, আত্রাই, নিয়ামতপুর ও মহাদেবপুর উপজেলায় ৩০টি গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এ সময়ের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত হয়ে জেলার ১১টি উপজেলার পশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা গরুর সংখ্যা ছিল ৫২৫।

তবে প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে লাম্পি স্কিন রোগে মারা যাওয়া ও আক্রান্তের সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা ও খামারিদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, যেসব আক্রান্ত গরুর চিকিৎসার জন্য পশু হাসপাতালগুলোয় নেওয়া হচ্ছে, কেবল সেই সংখ্যাই প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে নিবন্ধিত করা হয়। এর বাইরে যেসব খামারি আক্রান্ত গরু পশু হাসপাতালে না নিয়ে স্থানীয় পশুচিকিৎসক কিংবা ভেটেরিনারি ওষুধের দোকানদারদের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে চিকিৎসা করে থাকেন, সেই তথ্য প্রাণিসম্পদ কার্যালয়গুলোয় নেই। 

গতকাল রোববার (২৩ জুলাই) নওগাঁর বদলগাছি উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল চত্বরে এলএসডি রোগ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক আলোচনা সভা ও লিফলেট বিতরণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন উপজেলার বিলাশবাড়ী গ্রামের গরু খামারি জাহাঙ্গীর আলম। লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত তাঁর দুটি গরু চিকিৎসার জন্য পশু হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। 

খামারি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ছয়–সাত দিন হলো আমার একটি গাভি ও তিন মাস বয়সী একটি বাছুরের গায়ে গুটি গুটি দাগ দেখা দিয়েছে। ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে কয়েক দিন ধরে খাওয়াচ্ছি। কিন্তু অসুখটা ভালো হচ্ছে। এখানে নিয়ে আসলাম দেখি কি চিকিৎসা আর পরামর্শ দেয়।’

বদলগাছি উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরুর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে প্যারাসিটামল ও সর্দি থাকলে হিস্টাসিনজাতীয় ওষুধ খাওয়ানোর চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়া স্যালাইন খাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়। বসন্তের (পক্স) একটি জাত ভাইরাসের মাধ্যমে রোগটি ছড়াচ্ছে। এখন পর্যন্ত এ রোগ সারাতে কার্যকর কোনো ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি।

তবে গরুর এই রোগ প্রতিরোধে গোট পক্স (ছাগলের বসন্ত) টিকা আপাতত দেওয়া হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে এই টিকা ভালো কাজ দিচ্ছে। এই রোগ প্রতিরোধে, মতবিনিময় সভা, উঠান বৈঠক করাসহ ইউনিয়ন ভ্যাকসিনেটরদের মাধ্যমে খামারি ও কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

পোরশার নিস্কিনপুর গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল করিম বলেন, ‘লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত আমার চার মাস বয়সী একটি বাছুর ও প্রতিবেশী সাইফুদ্দিনের একটি বড় গরু মারা গেছে। আমার আরও তিনটা গরু আক্রান্ত হয়েছে। তিনটা গরুরই চিকিৎসা চলছে। নিস্কিনপুরেই গত এক মাসে ৬০ থেকে ৭০টি গরু আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া পাশের গ্রাম মোল্লাপাড়াতেও অনেক গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়েছে।’  

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দিন বলেন, ‘গরুর লাম্পি স্কিন রোগ একটা ভাইরাসজনিত রোগ। মশা, মাছি, ডাশজাতীয় রক্ত খায়, এমন পতঙ্গের মাধ্যমে এক গরু থেকে আরেক গরুতে এই রোগ ছড়ায়। রোগটা যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, এ জন্য আমরা খামারি ও কৃষকদের গরুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখা ও মশা, মাছি ও ডাশের কামড় থেকে রেহাই পেতে মশারি ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। এ ছাড়া গরুতে লাম্পি স্কিন রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পশু হাসপাতালে নিতে বলছি। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে রোগটা শতভাগ সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

প্রাণিসম্পদে সমৃদ্ধ এই জেলায় ২২ লাখ গবাদিপশু রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে গৃহস্থের বাড়ি ও খামারে লালন-পালন করা গরুর সংখ্যা ৮ লাখ ২২ হাজার।