মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা

  • ১৯৯৭ সালে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও শয্যা–পথ্য ছাড়া কিছু বাড়েনি।

  • ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা, ভর্তি রোগী ও বহির্বিভাগ সামাল দেওয়া দুরূহ হয়ে গেছে।

বরগুনার প্রায় ১২ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবার একমাত্র ভরসা বরগুনা সদর হাসপাতাল। কিন্তু এখানে চিকিৎসকসহ নানা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। যথাযথ সেবা না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগীদের।

সদর হাসপাতালে ভর্তি থাকা অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ রীমা বেগম গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রসববেদনায় কাতরাচ্ছিলেন। স্বজনেরা হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, হাসপাতালে গাইনি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা দেওয়া হয় না। তাঁদের অন্য কোথাও চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরে শহরের বেসরকারি ক্লিনিক ঘুরে শেষ পর্যন্ত রাস্তায় সন্তান প্রসব করেন রীমা বেগম।

বুকে ব্যথা নিয়ে দুই দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হন বরগুনা সদরের মাইঠা গ্রামের আবদুল কাদের (৫০) নামের এক রোগী। আবদুল কাদের বলেন, ‘এই দুই দিনে ডাক্তার ওয়ার্ডে আইছে একবার। হ্যারপর খবর নাই। ডাক্তার আসতে পারে, আবার না–ও আসতে পারে। এটা কোনো হাসপাতাল? চিকিৎসাই যদি না পাই, তয় এহানে আইয়্যা লাভ কী?’

চিকিৎসকের ৪৩টি পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ১১ জন। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রোগীরা।

হাসপাতাল প্রশাসন বলছে, এখানে পদ আছে ৪৩ জনের। বর্তমানে চিকিৎসক আছেন মাত্র ১১ জন। বাকি ৩২টি পদ শূন্য। এর মধ্যে ২১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদের ১৭টিই শূন্য। আর চিকিৎসা কর্মকর্তার ১৯টি পদের মধ্যে ১৪টি শূন্য। জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ২১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মধ্যে নাক কান গলা, শিশু, গাইনি, প্যাথলজিস্ট, মেডিসিন, চক্ষু, কার্ডিওলজির, অ্যানেসথেটিস্ট, অর্থোপেডিকস, রেডিওলজিস্ট ও সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকের পদ শূন্য।

এই হাসপাতালে একজন তত্ত্বাবধায়ক, একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও), একজন হোমিও চিকিৎসক, চারজন চিকিৎসা কর্মকর্তা, সার্জারি ও অ্যানেসথেসিয়া গাইনি ও অর্থোপেডিকস বিভাগের চারজন কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ আছেন।

জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. সোহরাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে হাসপাতালে মাত্র ১১ জন চিকিৎসক আছেন। এত অল্পসংখ্যক চিকিৎসকের পক্ষে ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা, বহির্বিভাগ ও ভর্তি রোগীদের সামাল দেওয়া খুবই দুরূহ কাজ। আমরা কীভাবে সেবা দিচ্ছি, সেটা বোঝাতে পারব না।’

হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও শয্যা আর পথ্য ছাড়া কিছু বাড়েনি। জনবলকাঠামো ও অবকাঠামো আগের মতো রেখেই ২০১০ সালের হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এখানে ছয়তলা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে নতুন ভবনটির উদ্বোধন হওয়ার পর বর্তমানে সেখানে করোনা ইউনিট করা হয়েছে।

চিকিৎসকেরা জানান, এই হাসপাতালে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ রোগী ভর্তি থাকেন। বহির্বিভাগে গড়ে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগীর চিকিৎসা দিতে হয়। এরপর প্রশাসনিক কাজ, ময়নাতদন্ত, ধর্ষণের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কাজকর্ম এই ১১ জনকেই করতে হয়। এত রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া একরকম অসাধ্য হয়ে পড়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি, সাধারণ রোগীরা যাতে সঠিক চিকিৎসা পান। আমরা সবাই আন্তরিকভাবেই হাসপাতালে রোগীদের দেখা শুরু করি। এত বড় একটি হাসপাতাল, এত রোগীর চাপ মাত্র ১১ জন চিকিৎসক দিয়ে কোনোভাবেই সামলানো সম্ভব নয়।’

গত বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পুরোনো ভবনের বহির্বিভাগে রোগীদের দীর্ঘ সারি। সেখানে কথা হয় চিকিৎসা নিতে আসা বরগুনা সদরের লাকুরতলা হেলেনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বুকে ব্যথা হওয়ায় চিকিৎসার জন্য সকালে আইছি। এহন বেলা বাজে ১১টা। অনেক মানুষ। মনে হয়, ডাক্তার দেখাইতে পামু না।’

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের জুনিয়র সার্জারি বিশেষজ্ঞ মো. তারেক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, অপারেশন করার সময় সহযোগী দরকার, হাসপাতালে জনবল না থাকায় ওয়ার্ড বয় ও সিস্টারদের নিয়ে অপারেশন করাতে হয়। অপারেশনের পর সহকারী দরকার, যাতে তাঁরা রাউন্ড দিতে পারেন। চিকিৎসক–সংকট থাকার কারণে ছুটি নিতে পারেন না। তিন বছর ধরে বাড়িতে যেতে পারেননি তিনি। কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই যে কেউ তাঁকে সাহায্য করবেন। জনবলসংকট থাকায় সেবাপ্রত্যাশী রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

শহরের উপকণ্ঠের লাকুরতলা এলাকার বাসিন্দা কবির হোসেন সার্জারি ওয়ার্ডে এক সপ্তাহ ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখানে চিকিৎসক না থাকায় তেমন সেবা পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বরগুনার চিকিৎসাব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের নয়। হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবলের সংকট রয়েছে। প্রতি মাসে সমস্যার কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার কমিটির আছে, তাদের সঙ্গে সভা করে সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।