গাজীপুরে যত্রতত্র জমা পানি, ডেঙ্গুর ঝুঁকি

কোথাও তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা জন্মাতে পারে। একটি স্ত্রী মশা একসঙ্গে ৭০ থেকে ১৫০টি ডিম পাড়ে।

হাসপাতাল ভবনের পেছনে পাকা নর্দমা। সেখানে জমে থাকা পানিতে পড়ে আছে ময়লা–আবর্জনা, যেন মশার বংশবিস্তারের আদর্শ পরিবেশ। গতকাল দুপুরে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের পেছনে
ছবি: প্রথম আলো

হাসপাতালগুলোতে যখন ডেঙ্গু রোগীর ভিড়, নগরবাসী যখন ডেঙ্গুর আতঙ্কে ভীত, তখন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকার সড়ক, ঝোপঝাড় ও বাসাবাড়ির সামনে যত্রতত্র জমে আছে বৃষ্টি বা নালার আবদ্ধ পানি। তাতে ভাসছে মশার লার্ভা। কিন্তু সেই পানি নিষ্কাশনে সিটি করপোরেশনের মাথাব্যথা নেই। ফলে প্রকট ডেঙ্গুঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোথাও তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকলে সেখানে এডিস মশা জন্মাতে পারে। একটি স্ত্রী মশা একসঙ্গে ৭০ থেকে ১৫০টি ডিম পাড়ে। আর এসব মশা বেঁচে থাকে দুই সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত।

ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়া–গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত আবদ্ধ পানিতে মশা, মাছি, ব্যাকটেরিয়া, পোকামাকড়সহ নানা ধরনের রোগজীবাণু ছড়ায়। সে ক্ষেত্রে পানিতে কীটনাশক প্রয়োগ অথবা চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কারণ, চলন্ত পানিতে মশা জন্মায় না। তা ছাড়া এডিস মশা জন্মাতে পারে এমন জায়গাগুলোতে কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত।

আমরা সবাই ডেঙ্গুর ভয়ে আছি, কিন্তু এসব নিয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো মাথাব্যথা নাই। সাধারণ মানুষ মরে গেলেও তাদের কোনো কিছু আসে যায় না।
বিলকিস আক্তার, নগরের টঙ্গী বাজার এলাকার বাসিন্দা

গাজীপুরের ৯টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে গত রোববার নগরের ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে টঙ্গীর ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও শোভাযাত্রার আয়োজন করেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান (কিরণ)। সেখানে তিনি জানান, নগরবাসীকে ডেঙ্গুমুক্ত রাখতে ৫৭টি ওয়ার্ডে একযোগে কাজ শুরু করেছেন তাঁরা। বিশেষ করে যেসব ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি বা ডেঙ্গুপ্রবণ, সেখানে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। ৫৭টি ওয়ার্ডে ১০০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে।

কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। নগরের যত্রযত্র জমে আছে পানি। আর সেখান থেকে বাড়ছে মশার উপদ্রব। গত রোববার ও গতকাল সোমবার নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডের সড়ক, বিপণিবিতান, বাসাবাড়ির আশপাশ জায়গায়, ঝোপঝাড় এমনকি হাসপাতালের সামনেও পানি জমে থাকতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও পানিতে ভাসছিল মশার লার্ভা।

টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় জমে আছে পানি। বিশেষ করে পুরোনো ভবনের পেছনে ঝোপঝাড় ও খালি জায়গায় জমে আছে পানি। সেখানে গিজগিজ করছে মশা। ব্যতিক্রম নয় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অঙ্গনও।

এ ছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন অংশে, এরশাদনগরের বিভিন্ন ব্লক, বোর্ডবাজার, ইশড্ডা, যুগীতলা, জোড়পুকুর, আউচপাড়া, দক্ষিণ খাইলকৈর, মরকুন, আক্কাস মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় একই চিত্র দেখা যায়।

নগরের টঙ্গী বাজার এলাকার বাসিন্দা বিলকিস আক্তার বলেন, ‘এখন চারদিকে ডেঙ্গুর ছড়াছড়ি। আমরা সবাই ডেঙ্গুর ভয়ে আছি, কিন্তু এসব নিয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো মাথাব্যথা নাই। সাধারণ মানুষ মরে গেলেও তাদের কোনো কিছু আসে যায় না।’

এ বিষয়ে জানতে গতকাল সোমবার যোগাযোগ করা হলে সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমানের সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়তই সব ওয়ার্ডে মশার ওষুধ দিচ্ছি। ঝোপঝাড় পরিষ্কার বা বদ্ধ পানি নিষ্কাশনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা প্রতিনিয়ত কাজ করছে।’

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়

নগর এলাকার প্রধান দুটি হাসপাতাল হলো শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতালটিতে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী। এ ছাড়া পুরো জেলায় রয়েছে ছোট-বড় বেশ কিছু সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল।

গাজীপুর জেলা সিভিল কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৮১৭। গতকাল সোমবার পর্যন্ত পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া মোট রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮১৪ জন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৭৮ রোগী।

জেলা সিভিল সার্জন মো. খায়রুজ্জামান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এলাকায় রোগীর সংখ্যা বেশি। উপজেলাগুলোতে রোগী কম। সে ক্ষেত্রে আমাদের যে যে ব্যবস্থা বা প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার, তার সবই আছে। ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট আছে, পাশাপাশি বেডের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে।’