ঈদুল আজহা সামনে রেখে খুলনা নগরের জোড়াগেট কোরবানির পশুর হাটে প্রতিদিনই গরু ও ছাগলের সংখ্যা বাড়ছে। বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে নদীপথ ও সড়কপথে পশু এসে জমা হচ্ছে এই হাটে। তবে এখনো পুরোপুরি জমে ওঠেনি কেনাবেচা। হাটে বিক্রেতার ভিড় থাকলেও তুলনামূলকভাবে ক্রেতা কম। অনেকেই এসে পশু দেখছেন, ছবি তুলছেন, দরদাম করছেন; কিন্তু হাতবদল হচ্ছে কমই।
বিক্রেতারা বলছেন, এখনো বাজারের গতি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সাধারণত যাঁরা প্রতিবছর কোরবানি দেন, তাঁদের অনেকেই এবার চুপচাপ আছেন। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে খরচে সতর্কতা অবলম্বন করছেন অনেকেই। পাশাপাশি, শহরে পশু রাখার জায়গার সংকট থাকায় অনেক ক্রেতা ঈদের এক-দুই দিন আগে গরু কেনাকাটায় বেশি আগ্রহী হন। এতে হাটের মাঝামাঝি এই সময়ে বেচাকেনা কম দেখা যাচ্ছে।
ওই হাটে ওঠা একটি গরু সবার দৃষ্টি কেড়েছে। ২০ মণ ওজনের গরুটির নাম রাখা হয়েছে ‘পিটবুল’। ফ্রিজিয়ান জাতের গরুটি এসেছে বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার গাংনী থেকে। গরুটির মালিক মো. শফিউল্লাহ বলেন, ওষুধ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে এলাকায় মাছ আর গরুর খামার গড়েছেন। এই গরুর বয়স ৫ বছর ৯ দিন। দাম চাইছেন ১৪ লাখ টাকা। এটা এখন পর্যন্ত এই হাটের সবচেয়ে বড় গরু। মানুষ দেখে যাচ্ছেন, ছবি তুলছেন; তবে এখনো কেউ দাম বলেননি।
হাটে ‘পিটবুলের’ মতো বড় গরুর সংখ্যা খুব বেশি নয়। মাঝারি আকারের গরুরই আধিক্য। ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যের গরুর চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে ক্রেতারা অভিযোগ করছেন, দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি।
গরু এখনো হাট ভরে যায়নি উল্লেখ করে নগরের রয়্যাল মোড় এলাকার বাসিন্দা আছিয়া বলেন, ‘এই হাটের বড় সমস্যা হচ্ছে হাসিল। আমি যদি ৫ লাখ টাকার গরু কিনি, তাহলে ২০ হাজার টাকা শুধু হাসিল দিতে হবে। অনেকেই এই কারণে হাটে আসছেন না। অনেকে শহরের আশপাশের হাট বা খামার থেকেই কিনে নিচ্ছেন। এই হাটে দামও বেশি। আমি যেটা দেখলাম, সেটার দাম চাচ্ছে ৫ লাখ টাকা। ঢাকায় হলে এই গরুর দাম চাইত ৪ লাখ টাকা। এরপর দামিদামি তো আছেই।’
শামসুল আলম নামে একজন ক্রেতা ১ লাখ ৫ হাজার টাকায় একটি গরু কিনে বলেন, ‘গত বছর একই ধরনের গরু কিনেছিলাম ৮৫ হাজার টাকায়। এবার তুলনামূলক দাম কিছুটা বেশি পড়ে গেছে।’
১ জুন শুরু হওয়ার পর হাটে পশুর সংখ্যা কম ছিল, বিক্রিও তেমন হয়নি। তবে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিভিন্ন জেলা থেকে গরু-ছাগলসহ অন্যান্য পশু আসতে শুরু করেছে। পশুর মধ্যে গরুর সংখ্যাই বেশি। সবচেয়ে বেশি গরু এসেছে নড়াইলের কালিয়া এলাকা থেকে।
নড়াইলের কালিয়া থেকে বিক্রির জন্য গরু নিয়ে এসেছেন মো. রাজু। তিনি বলেন, ‘আড়াই লাখ টাকা দাম চাচ্ছি। কেউ দাম বলছেন না। দেখা যাক, হাট জমার পর কী হয়।’ একই এলাকার খামারি জামির বিশ্বাস বলেন, ‘২৫ বছরের বেশি সময় ধরে এই হাটে আসি। কোনোবার একেবারে লোকসান হয় না। এবার দুটি মাঝারি গরু এনেছি। মানুষ দাম বলছেন না। জানি না, শেষ পর্যন্ত কী অবস্থায় যাব।’
জিরো পয়েন্ট এলাকার মুন অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে মাঝারি আকৃতির পাঁচটি গরু আনা হয়েছে। বিক্রয়কর্মী তানভীর হোসেন বলেন, ‘২ লাখ ২০ হাজার থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দাম চাচ্ছি। এখনো কেউ দাম বলেননি।’
হাটের পাশেই পশুর খাদ্য ও আনুষঙ্গিক পণ্য নিয়ে বসেছেন মৌসুমি বিক্রেতারা। বিক্রি হচ্ছে গমের ভুসি, পাতার ভুসি, ধানের ভুসি, খইল, শুকনা খড় ও তাজা ঘাস। সঙ্গে রয়েছে চাটাই, টুকরি, গাছের গুঁড়ি, রঙিন মালা ইত্যাদি। মৌসুমি ব্যবসায়ী নাঈম বলেন, বেচাকেনা শুরু হয়নি বললেই চলে। অলস সময় কাটছে।
হাটের নিয়ন্ত্রণকক্ষ সূত্রে জানা গেছে, আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হাটে মাত্র ১৪৬টি পশু বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে গরু ৮৯টি ও ছাগল ৫৭টি। এ পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা।
খুলনা সিটি করপোরেশনের স্টেট অফিসার গাজী সালাউদ্দীন এই হাটের পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্বে রয়েছেন। আজকালের মধ্যেই হাট জমজমাট হয়ে যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূল কেনাবেচা হয় ঈদের আগের দুই দিন ও ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত। তখন বিক্রেতাদের দম ফেলার সময় থাকে না। এখন নদী ও সড়কপথে পশু আসছে।
গাজী সালাউদ্দীন আরও বলেন, এবার হাটে হাসিল কমানো হয়েছে। অন্য বছরের ৫ শতাংশের পরিবর্তে এবার ৪ শতাংশ হারে হাসিল নেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তাও অনেক জোরদার করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল রয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। হাসিল ছাড়া অন্য কোনো খাতে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই।
২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খুলনা সিটি করপোরেশন হাটটির আয়োজন করে ঈদের আগের সপ্তাহজুড়ে। গত বছর এই হাটে ৬ হাজার ২৭টি পশু বিক্রি হয়েছিল এবং রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা।